- ঐকমত্য কমিশনে ৩১ দলের মধ্যে ২৬ দলই পিআর চায়
- সুশাসনের জন্য পিআর চান বিশেষজ্ঞরাও
আগামী নির্বাচনে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন, সংখ্যানুপাতিক জনপ্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ ইস্যু এখন আলোচনার তুঙ্গে। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি পিআর পদ্ধতির কঠোর বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ প্রথম সারির কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ দল একমত বলে জানিয়েছিলেন। তিনি এও জানিয়েছিলেন যে কয়েকটি দল এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছে। ২৯ জুন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়ে দেন ঐকমত্য কমিশনের ৩১ দলের মধ্যে ২৬টি দলই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়।
এর আগের দিন ২৮ জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় মহাসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সেখানে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে তুলে ধরেন বিভিন্ন দলের নেতারা। সেদিন ১০টি রাজনৈতিক দল একমঞ্চে উঠে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে দাবি তুলে ধরে বলেছেন, পিআর পদ্ধতি না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।
এরপর থেকে মাঠে গড়ায় প্রোপরশনাল রিপ্রেজেনটেশন নিয়ে আলোচনা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পালানোর পর আর কোন ফ্যাসিবাদ যেন দেশে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য মূলত পিআর পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ। পদ্ধতিটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাদৃত। পিআর পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন। তবে অনেক সময় প্রচলিত ভোট পদ্ধতিতে দেখা যায়, একটি দল সীমিত ভোট পেয়েও অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়ে যায়, আর অধিক ভোট পাওয়া দলের কোনো আসনই থাকে না। এমন বৈষম্য থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বিশ্বের বহু দেশ গ্রহণ করেছে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা।
প্রথমবার ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে চালু হয় পিআর পদ্ধতি। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪% দেশে, পিআর ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উন্নত দেশের সংগঠন ওইসিডি’র ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০% দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া একটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ও হারের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন হয়। নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যায় যেখানে অংশ নেওয়া ৭০ ভাগ জনগণ বলেছেন, তারা পিআরের পক্ষে। বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এক জনমত জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ মানুষ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে মত দিয়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাপ্ত ভোটের ওপর নির্ভর করে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন চান ৭১ শতাংশ মানুষ। বিরোধী দল থেকে নিম্নকক্ষে একজন ডেপুটি স্পিকার নিয়োগের পক্ষে মত ৮৬ শতাংশ মানুষ। এছাড়া ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে নারী আসন সংরক্ষণ চান ৬৩ শতাংশ মানুষ। পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা ও পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যথাযথ নিষ্পত্তির জন্য স্থায়ী স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন চান ৯০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সংবিধান সংশোধন চান ৮৫ শতাংশ মানুষ।
এর সূত্র ধরে ৭০ ভাগ জনগণ পিআরের পক্ষে বলে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, জনগণ যদি পিআর মানে, আপনাদেরও মানতে হবে। না মানলে জনগণ যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা তা মেনে নেবো। তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন রাজনীতির অংশ। জরিপে ৭০ ভাগ জনগণ বলেছেন, তারা পিআরের পক্ষে। আমরা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি যে গণভোট দিন। জনগণ যদি পিআর মানে, আপনাদেরও মানতে হবে। না মানলে জনগণ যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা তে মেনে নেব।
কেননা, পিআর পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি, পেশিশক্তি ও কালো টাকার ব্যবহার এবং কেন্দ্র দখলের সুযোগ থাকে না। প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে দলের এমপি নির্বাচিত হবে। এখানে ব্যক্তি নয়, দলের স্বার্থ থাকে। তিনি বলেন, আমরা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকব। আশাকরি, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিও জনগণ মেনে নেবে একদিন।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পিআরের পক্ষে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া একটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ও হারের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন হয়।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনে তো কোন দোষ নেই। আমাদের মধ্যে একটা নতুন লিগ্যাল আরগুমেন্ট আইনগত চিন্তাধারায় একটা বৈপ্লবিক নতুন ধারা জন্ম নিয়েছে। পিআর পদ্ধতির ভোট গ্রহণের ধারণাকে এমনভাবে জনসম্মুখে তুলে ধরা হচ্ছে জাতির সামনে, এই যুক্তি নতুন প্রজন্মের অনেক বড় প্রভাব পড়বে।