স্টাফ রিপোর্টার: দেশের কোন নাগরিকের সাথে যেন কেউ খেলাধুলা না করে উল্লেখ করেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা ফ্যাসিস্ট আমলে একটা কথা শুনতাম খেলা হবে, ওই খেলা আর দেখতে চাই না। আমরা রাষ্ট্রে কোনও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাই না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কেউ যদি খেলে, তাহলে আমরা কারও দাবার ঘুঁটি হবো না। কেউ আমাদের সঙ্গে খেলবেন, তা পছন্দ করি না। শুধু আমাদের সঙ্গে না, এ দেশের একজন নাগরিকের সঙ্গেও যেন কেউ খেলাধুলা না করে। জাতির ভাগ্য নিয়ে যারা খেলাধুলা করে তারা এদেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হতে পারে না।

গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগরী জামায়াতের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকির। বক্তব্য রাখেন দক্ষিণের নায়েবে আমীর এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন ড. আব্দুল মান্নান, ডিইউজে সভাপতি মো: শহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

ফ্যাসিবাদের পতন হলেও এখনও চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব বন্ধ হয়নি উল্লেখ করে শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদীদের তাড়িয়েছে। কিন্তু আমরা ফ্যাসিবাদের জ্বালা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। যে সমস্ত অপকর্ম করতো ফ্যাসিবাদীরা, সেই অপকর্ম যদি আমিও করি তাহলে আমিও একজন ফ্যাসিবাদী। আমরা বারবার অনুরোধ করে বলেছি, দয়া করে শহীদের রক্তের প্রতি সম্মান জানান। দয়া করে আহত-পঙ্গু ভাই-বোনদের প্রতি সম্মান দেখান। তাদের রক্তকে, জীবনকে, তাদের ইজ্জতকে, তাদের আবেগকে, তাদের ত্যাগকে মেহেরবানি করে অপমানিত করবেন না। কিন্তু আমরা দেখছি কতিপয় কাজ এখনো বন্ধ হচ্ছে না। আমরা বারবার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছি কিন্তু এই আহ্বান আমরা কেয়ামত পর্যন্ত জানাবো না। কারণ এই জুলুমটা সারা জাতির উপর হচ্ছে। ঘাটে-ঘাটে যে চাঁদাবাজি হয় এর কারণে প্রত্যেকটা দ্রব্যমূল্য বহুগুণ বেড়ে যায়। এর চাপ এ দেশের একজন শ্রমজীবী মানুষের ওপর পড়ে। এমনকি রাস্তার আমার একটা ভিক্ষুক ভাই অথবা বোনের ওপরেও পড়ে। তাহলে তো আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা কেন এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব, কেন আমরা নীরবে সহ্য করব? কাজেই এ ব্যাপারে আমাদেরকে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ইনশাআল্লাহ।

তিনি আরও বলেন, 'বিনয়ের সাথে বলি, এ কাজ বন্ধ করুন। জাতিকে স্বস্তির সঙ্গে বাঁচতে দিন, সামনে এগিয়ে যেতে দিন। আবার যাতে ফ্যাসিবাদের নতুন ধারার অধ্যায় তৈরি না হয়, তার থেকে ফিরে আসুন। ফিরে না আসলে ভাই আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। আমরা এ লড়াই বাদ দেব না। আমরা অবিরাম চলা সৈনিক। আমি দুনিয়া থেকে চলে যেতে পারি কিন্তু এই কাফেলা থাকবে ইনশাআল্লাহ।'

ভুল করলে সমালোচনা করার অনুরোধ জানিয়ে জামায়াতের আমীর বলেন, জোর করে আমাদের নামে কেউ কোনও ভুল তৈরি করলে তা মানবো না। আমরা যেটা করি না, মানি না, সেটা যদি আমাদের নামে চালান দেওয়া হয়, তার প্রতিবাদ করা আমাদের দায়িত্ব। আপনার ভাষায় সমালোচনা করুন কিন্তু সেটাতে সত্যতা, যথার্থতা থাকবে হবে।

জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের ওপর আওয়ামী লীগ সরকার জুলুম করেছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টে’ তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন দলটির আমীর। তিনি বলেন, পট-পরিবর্তনের সপ্তম মাসে আমরা আছি, এখনও কেন তাকে হাজতে থাকতে হবে? মনের কষ্ট থেকে বলেছি আমার এখন বাইরে থাকার কোনও সার্থকতা নেই। প্রতিবাদে আমি স্বেচ্ছায় জেলে যেতে চাই। লাখো কর্মী আমার সঙ্গে জেলে যাওয়ার কথা বলেছেন। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের বলছি, লাখো লাগবে না। আমি একাই যাবো। এ জমিনকে ঠিক করার জন্য আমার সহকর্মীদের বাইরে থাকতে হবে। সবাই ভেতরে থাকলে জঞ্জাল পরিষ্কার করবে কে, আমি মজলুমের প্রতীক হিসেবে জেলে থাকি। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে, অনেক ধৈর্য ধরেছেন, আর একটু ধৈর্য ধরুন।

আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি এটিএম আজহারুল ইসলামের রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদনের শুনানি আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে হওয়ার কথা রয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমকে মুছে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করে শফিকুর রহমান বলেন, ভাষা আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের যতটুকু অবদান ততটুকু দিতে অসুবিধা কোথায়? বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের স্মারকের ড্রাফট করেছিলেন, তাকে কোথাও স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন (তমদ্দুন মজলিশ) ইতিহাস থেকে বিলীন কেন? যার যেখানে জায়গা, তাকে সেখানে জায়গা করে দিতে হবে। তাহলে এ জাতির মধ্যে বার বার বীর জন্ম নেবে। বীরদের স্বীকৃতি না দিলে সুবিধাবাদী কাঙাল জন্ম নেবে। যারা গরীবের ধন লুটে খাবে।

নায়েবে আমীর ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, ভাষা আন্দোলনে ইসলামপন্থিদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডাকসুর জিএস অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বে সাহসিকতার সাথে তৎকালীন শাসকদের স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখছি সেই অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম ডাকসুর তালিকা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, একুশ হচ্ছে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য যারা জীবন দিয়েছে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের দেশে যদি দখলদারিত্ব হয়, চাঁদাবাজি হয় সেটি অন্যায় নয়, প্রশ্ন রাখেন তিনি। সেই একুশের চেতনাকে ধারণ করে আমরাও অন্যায় ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। এদেশে যদি কেউ আবার চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব করতে চায়, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধেও আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। তিনি বলেন, আমরা খুব দুর্ভাগ্যের সাথে লক্ষ্য করছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা তৈরি করে সংস্কারকে ব্যাহত করার চক্রান্ত চলছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এই সরকারকে ব্যর্থ করে শুধু একটি নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে কেউ কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এসব বাস্তবায়ন করছে। আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হেলমেট বাহিনী ছিল, হাতুড়ি বাহিনী ছিল। এখন কেউ কেউ রামদা বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। বিগত ১৫ বছর যারা মাদ্রাসায় হামলা করার সাহস পায়নি, অথচ কেউ কেউ নতুন করে ফ্যাসিবাদের এমন পরিচয় দিচ্ছেন যে মাদ্রাসার ছাত্রদের আহত করতেও তারা দ্বিধা করেনি। তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্রকে হামলা করার মধ্য দিয়ে সেই চরিত্রকেই প্রকাশ করেছে।

সভাপতির বক্তব্যে আব্দুস সবুর ফকির বলেন, যে মাটিতে রক্ত ঝরে সে মাটি উর্বর হয়। সেই মাটির জনগণকে কখনো দাবিয়ে রাখা যায় না। ভাষা আন্দোলনের সূচনা প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম এর নেতৃত্বে তমুদ্দিন মজলিসের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। তিনি তার নিজ বাড়ি থেকে সেদিন ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। সেই ঘোষণাপত্রের মধ্যেই স্বাধীনতার মূল মন্ত্র লুকায়িত ছিল। যেভাবে আমরা ২৪ এর আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি ঠিক সেভাবেই ৫২ র ভাষা আন্দোলনেও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, অধ্যাপক গোলাম আযম সহ তৎকালীন নেতৃবৃন্দ কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্রদেরকে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অথচ ডাকসুর জিএস হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম তালিকায় এখন নেই, কিন্তু ভিপির নাম রয়েছে। কেউ কি প্রশ্ন তুলেছে যে ভিপির নাম আছে কিন্তু জিএসের নাম নেই কেন? এ বৈষম্য এখন দূর করতে হবে। ইতিহাস বিকৃতি করে কোন লাভ নেই।

এর আগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান। মহানগরী দক্ষিণ কার্যালয়ের সামনে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদান সহ ফ্রি রোগী দেখা ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।

উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি দেলাওয়ার হোসেন মো. কামাল হোসাইন, ড. আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান, মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য ডাঃ আতিয়ার রহমান, ড. মোবারক হোসেন, জয়নুল আবেদীন, কামরুল আহসান হাসান প্রমুখ।