যুক্তরাজ্যে প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে খালেদা জিয়া ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী কাতারের বিশেষ রাজকীয় বিমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশে এসেছেন তার দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান। বিগত বছরগুলোতে শর্মিলা রহমান বিভিন্ন সময় দেশে অবস্থান করলেও ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশত্যাগের পর এই প্রথম দেশে ফিরলেন জোবাইদা রহমান। বিমানবন্দর থেকে লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হতে হতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছান বেগম জিয়া।
সাবেক তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে গতকাল সকাল থেকেই বিমানবন্দরে বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ঢল নামে। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই নেতাকর্মীরা বাইরের সড়কে জড়ো হন। খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল লক্ষণীয়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি কাজ করে সেনাবাহিনীও।
প্রসঙ্গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়। ওইদিন লন্ডনের বাসা থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই গাড়ি চালিয়ে মাকে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন। বিমানবন্দরে দলের চেয়ারপার্সনকে বিদায় জানাতে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপির নেতাকর্মীদের ঢল নেমেছিল।
গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান। সেখানে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কথা জেনে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তার যুক্তরাজ্যে গমনের জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছিলেন। সেটিতে করে তিনি লন্ডন যান এবং গতকাল ফিরেছেনও সেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ফিরে আসা গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সহজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বিমানবন্দরে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল ফ্যাসিবাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ বিদায় নেওয়ার পর বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় ৪ মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসছেন। এটা আমাদের জন্য, জাতির জন্য একটা আনন্দের দিন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের এই সময়ে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার ফিরে আসা আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সহজ করবে। দেশকে সঠিক ও বৈষম্যহীন পথে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলীয় ও জাতীয় পতাকার পাশাপাশি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবি হাতে নিয়ে রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতে অবস্থান নিয়েছেন। সেখানে তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন। খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি অবস্থান করে বিমানবন্দর থেকে লা মেরিডিয়েন হোটেল পর্যন্ত এলাকায়। ছাত্রদল অবস্থান করেছে লা মেরিডিয়েন হোটেল থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত এলাকায়। যুবদল খিলক্ষেত থেকে হোটেল র্যাডিসন পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি হোটেল র্যাডিসন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত এলাকায়, স্বেচ্ছাসেবক দল আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত এলাকায়, কৃষক দল বনানী কবরস্থান থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত এলাকায়, শ্রমিক দল কাকলী মোড় থেকে বনানীর শেরাটন হোটেল পর্যন্ত এলাকায়, ওলামা দল, তাঁতী দল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল শেরাটন হোটেল থেকে বনানী কাঁচাবাজার পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান করেছে। পেশাজীবী সংগঠনগুলো বনানী কাঁচাবাজার থেকে গুলশান-২ পর্যন্ত এলাকায়, মহিলা দল গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর থেকে গুলশান অ্যাভিনিউ রোড পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে খালেদা জিয়াকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এসময় নেতাকর্মীরা ‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘খালেদা, জিয়া’, ‘তারেক রহমান’, ‘খালেদা জিয়া ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ স্লোগান দেন। বিএনপি নেত্রী সাধারণত গাড়ির সামনে না বসলেও গতকাল তাকে সামনে বসতে দেখা গেছে। পেছনের আসনে বসেন তার দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান। পথে পথে নেতাকর্মীদের প্রতি হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন খালেদা জিয়া। এসময় তাকে খুবই হাস্যজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাই’ কথাগুলো বলছিলেন জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকে ঢাকায় আসা ইকবাল করিম নামের এক বিএনপি সমর্থক। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে গত সোমবার ঢাকায় আসেন তিনি। একই সুরে কথা বলেন ময়মনসিংহ থেকে আসা নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, বিএনপি একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। অনেক বছর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। আশা করছি এ সরকার দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন খালেদা জিয়া। পানি বিক্রেতা শ্যামলী বেগম বলেন, খালেদা জিয়া আইবে এজন্য এত লোক আজ। আমরা বিএনপির লোক, বিএনপিরে ভোট দিমু। রাজধানীর ক্ষিলখেত এলাকার চা দোকানি হাফিজুর রহমান বলেন, এয়ারপোর্ট ও এই রাস্তায় এত লোক আগে কখনো হয়নি। খালেদা জিয়া একজন জনপ্রিয় নেত্রী, তার জন্যই এত মানুষ এসেছে। তিনি আমাদের দেশের একমাত্র নেত্রী, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই। মহাখালী রেলগেট এলাকার চা বিক্রেতা বাবু শেখ বলেন, সারাদেশে সব থেকে বেশি সমর্থক আছে বিএনপির। কিন্তু এতদিন অনেকেই ভোট দিতে পারেনি। এবার ভোট দিয়ে খালেদা জিয়াকে আবারও প্রধানমন্ত্রী বানাতে চাই। রিকশাচালক নাজির মিয়া বলেন, শেখ হাসিনা ৮ মাস হলো পালাইয়া গেছেন। তার জন্য কোনোদিন আজকের মতো এত মানুষ হয়নি। খালেদা জিয়া অনেক ভালো মানুষ, এজন্য আজ লাখ লাখ মানুষ হইছে।
লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছেন খালেদা জিয়া। ফিরোজায় খালেদা জিয়া পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান তার মেজ বোন সেলিমা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, শামীম ইস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, জুবাইদা রহমানের বড় বোন শাহীনা জামান বিন্দু এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। ফিরোজায় পৌঁছানোর পর গাড়ি থেকে নেমে অল্প কিছু পথ হেঁটে বাসায় ঢুকেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তার দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান তাকে হাঁটতে সাহায্য করেন। তবে, বাসার ভেতরে পৌঁছানোর পর তিনি আবার হুইল চেয়ারেই বসেন। খালেদা জিয়া যখন ফিরোজায় প্রবেশ করছিলেন তখন হাজারো নেতাকর্মীর শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে আশপাশের এলাকা। এসময় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গেছে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফেরা উপলক্ষে খালেদা জিয়ার ঢাকার গুলশানের বাসভবনে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ ভোজের। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বাবুর্চি এই বিশেষ ভোজের আয়োজন করেন। জিয়াউর রহমান স্যারের সময় থেকে যিনি রান্না করতেন, তিনিই আজ রান্না করেছেন। তবে, শায়রুল কবির খান বিশেষ ভোজের মেন্যু সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি।
দেশে পৌঁছে কাতার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছে তিনি কাতার সরকারের প্রতি এই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, কাতার সরকার শুধু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সই প্রদান করেনি বরং বিমানের খরচ, ওষুধ এবং চিকিৎসা সেবার সবকিছু নিশ্চিত করেছে। এই সহায়তার জন্য খালেদা জিয়া কাতার সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, কাতার সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য সবকিছু নিশ্চিত করেছে এবং এই মানবিক সহায়তা দেশনেত্রীর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে, যারা খালেদা জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করেছে। ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব সংস্থা মানবিক অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজার ভেতরে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, তিনি অনেক ভালো আছেন। তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছেন। আমরা যতটা ভেবেছি, তার চাইতেও অনেক ভালো আছেন ম্যাডাম। ফিরোজার ভেতরে প্রিয় নেত্রীকে সালাম জানাতে ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মো. এজমল হোসেন পাইলট। তিনি বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই দেশের জনগণের জন্য একটি বটবৃক্ষের শীতল ছায়া। বারবার গণতন্ত্র যখনই হোঁচট খেয়েছে তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে তা উদ্ধার করার লড়াইটা জারি রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, বেগম খালেদা জিয়া শুধুমাত্র একটি দলের সম্পত্তি নন, তিনি পুরো দেশের সম্পদ। প্রিয় নেত্রীকে সুস্থ দেখে দেশবাসীর মতো আমাদের অনেক ভালো লেগেছে।