‘ প্রিয় রাজনৈতিক দলের সদস্য বৃন্দ, বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মতভেদ থাকবে। কিন্তু সেই ভিন্নমত নিরসনে আলোচনা হবে। গণতন্ত্রের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাতে মুখ দেখাদেখি যাতে বন্ধ না হয়, সেই লক্ষ্যে জাতীয় স্বার্থে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজন। কারণ আমি বিশ্বাস করি, ধর্ম,দর্শন, মত যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার’। এমন আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এমন আহ্বান তিনি অসংখ্যবার জানিয়েছেন। তবে গতকালকের আহ্বানের মধ্যে একটি আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ লক্ষ্য করা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বড় দল হিসেবে সবাইকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ রাখার দায়িত্ব বিএনপির। সেটি অনুধাবন করতে পেরেছেন তারেক রহমান। তাই তিনি সবাইকে নিয়ে আগামীর পথচলায় শরীক করতে চান।
সূত্রমতে, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে কিছুটা বিভাজন তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল সাম্প্রতিক সময়ে নানা ইস্যুতে ভিন্নমত পোষণ করছেন। এটিকে সবাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য বললেও তৃণমূলে এর প্রভাব দৃশ্যমান। মূল দলের বাইরে অঙ্গ সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী এসব ভিন্নমতকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাপূর্ণ ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও শীর্ষ নেতারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন ঘোষণা দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের আমলে দেশ অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোর পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে এই যাত্রা কিন্তু খুব সহজ হবে না, যদি না গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোর মাঝে একতা না থাকে। তাদের ঐক্যবদ্ধহীনতার সুযোগ নিতে পারে ফ্যাসিবার্দে দোসররা। যা সম্প্রতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্নস্থানে দেখা যাচ্ছে। তারা ইস্যু পেলেই ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপরও হামলা চালাচ্ছে। গোপালগঞ্জের ঘটনা সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশের জনগণের সামনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অপার সম্ভাবনা এবং সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকাটা জরুরি। রাজনৈতিক ঐক্য থাকলেই কেবল ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে না।
সূত্রমতে, বিগত সময়ে দেশে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিসসহ সমমনা দলগুলো একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নানা পটপরিবর্তনে সেই ঐক্যে কখনো ভাটা পড়েছে, আবার ঐক্য গড়ে উঠেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা এবং বিভিন্ন দলের নেতাদের ভাষ্যে নতুন এক বাস্তবতা ফুটে উঠছে। জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক এখন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে, যেখানে দ্বন্দ্বের চিহ্ন স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে নতুন এক সমীকরণের সূচনা হতে পারে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সেটি কারো জন্য সুখকর হবে না। তারা বলছেন, এই মেরুকরণ যাতে গনতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোর মাঝে বিভাজন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য বড় দল হিসেবে বিএনপিকে দায়িত্ব নিতে হবে বেশি।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি ও জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রাজনৈতিক জোট ভেঙে দেয়। এরপর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের উত্তাপ কখনো বেড়েছে আবার কখনো স্বাভাবিক থেকেছে। তবে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে। শেখ হাসিনার সরকার পতনে বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিলেও আসন্ন নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এ দ্বন্দ্বের মূল কারণ সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলছেন, বিএনপি ও জামায়াতের দ্বন্দ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা। বিএনপির নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই জামায়াতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অভিযোগ তুলে তাদের ভূমিকা সামনে আনছেন। ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা ও তাদের ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনার ঝড় ওঠে, তখন জামায়াত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে চেষ্টা করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জামায়াতের বক্তব্য ও অবস্থান বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে। বিএনপির এমন সমালোচনার পর জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ গণমাধ্যমে বলেন, জামায়াত ইসলামী জনগণের কাছে তার ভূমিকা স্পষ্ট করেছে এবং জনগণ অব্যাহতভাবে দলটিকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াত বরাবরই আলাদা দল ছিল এবং আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানও আলাদা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এসব বক্তব্য দুটি দলের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। তিনি আরও বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে।
অনেকেই বলছেন, এ মুহূর্তে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলের জন্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জনগণের সমর্থন অর্জন জরুরি। বিশেষত তারা যদি অতীতের ন্যায় জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশে কোনো ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে পারবে না। আর যদি কাঁদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকে তাহলে সেটি উভয় দলের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গনতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে বর্তমান দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে আরও গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত বহন করছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগেই যদি দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়, তাহলে এটি একটি বড় রাজনৈতিক অশান্তির কারণও হতে পারে। যার সুযোগ পতিত স্বৈরাচার নিতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক কর্মসূচিতে বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াত যেভাবে গত ১৬ বছর নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনাকে উৎখাত করেছে, সেভাবেই সামনে যে কোনো জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
প্রায় দুই যুগ ধরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোটের নেতৃত্বে ছিল বিএনপি ও জামায়াত। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর দূরত্ব বাড়তে থাকে। নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে পতিত আওয়ামী লীগকে সুযোগ দিতে চায় না দল দুটিই। দেশের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চায় বিএনপি-জামায়াত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও ভারত ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চায়। দল দুটি মনে করছে বিএনপি ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধ থাকলে সকল ষড়যন্ত্র ভেস্তে দেয়া সম্ভব। কিন্তু সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে আওয়ামী লীগ। পার্শ্ববর্তী দেশ তাদের সব রকম সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। তাদের এজেন্টরা এখনো দেশের মধ্যে সরব রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হলে লাভবান হবে পতিত আওয়ামী লীগ। সেই সুযোগ দিতে চায় না দল দুটি। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের লন্ডনে বৈঠক হয়েছিল, যা প্রথমে দুই দলের সম্পর্কের বরফ গলানোর ইঙ্গিত দেয়।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্বাস বলেন, হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা এখনও রয়ে গেছেন। ওই দোসরদের রেখে দেশ এগুতে পারে না। ওরা ষড়যন্ত্র করছে। তবে জামায়াত ও বিএনপি একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে আর আওয়ামী লীগ আসতে পারবে না। দেশের স্বার্থে দুই দলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জামায়াত ও বিএনপি মিলে একসঙ্গে দেশ সাজাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম এবং থাকব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু প্রচারণা থাকলেও তা আমাদের দলীয় অবস্থান নয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে দুটি রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যখন ঐক্যহীনতা তৈরি হয়, তখন সংকট গভীরতর হয়। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা দ্বিতীয় স্তরে পড়ে যায়। এখন সময় ঐক্যের, বিভেদ নয়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় জামায়াত ও বিএনপি। সঙ্গে ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং আজিজুল হকের ইসলামী ঐক্যজোট। প্রথমে এরশাদ ও পরে আজিজুল হক জোট ছেড়ে দেন। তবে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও জামায়াতকে বিএনপি কখনো ছাড়তে রাজি হয়নি। বিএনপি চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ করে পরে ২০-দলীয় জোট গড়েছে। পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরও একটি জোট তারা করে গত সংসদ নির্বাচনের আগে। এর মধ্যে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ নানা সময়ই এসেছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, তারা এক আছেন, এক থাকবেন।