গণভোটের আড়ালে পতিত পরাজিত পলাতক অপশক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কিনা- এ ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, স্বল্পমেয়াদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণ সব ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা আশা করে না। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্বও নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করেছে। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি একটি রাজনৈতিক দলের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করবে? নাকি দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেবে। তিনি বলেন, সংবিধানে লেখা থাকলেই সব কিছু নিশ্চিত হয়ে যায় না। আসলে সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র রাজনীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতার। প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মানসিকতা।সর্বোপরি প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য। গতকাল বুধবার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিপ্লব ও সংহতি দিবসের আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন।
এই মুহূর্তে জনকল্যাণমূলক কর্মকা-ে মনোনিবেশ করা বেশি দরকার জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে, চাকরিদাতাদেরকে কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে কিনা? দেশের নারী সমাজের মধ্যে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়ছে, আমার মনে হয় এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবী নারীদের মনে ছড়িয়ে পড়া চাকরি সংকোচনের আতঙ্ক কাটানো এই মুহূর্তে কথিত গণভোটের চেয়ে বেশি দরকার।
তারেক রহমান বলেন, দেশে বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। দেশে উচ্চমাধ্যমিক এবং গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী প্রতি ৫ জনের একজন বেকার। বিজিএমইএ জানিয়েছে- গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে কমপক্ষে ৩৫৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এক লাখ ২০ হাজারের মতো শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।কর্মহীন এসব মানুষগুলোর কাছে রাষ্ট্রের হাজার টাকা ব্যয় করে কথিত গণভোটের চাইতে একটি চাকরি কি বেশি জরুরি নয়?
তিনি বলেন, আনফরচুনেটলি আমরা মাসের পর মাস রাষ্ট্র মেরামতের নানা উপাদান নিয়ে আলোচনা করলেও এই রাষ্ট্রের লাখ লাখ বেকারদের কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনার জন্য একটি দফাও উত্থাপন করিনি বলেই মনে হয়। দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এত সংস্কার কমিটি হলো অথচ একটি শিক্ষা সংস্কার কমিটি করা হলো না। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়ের একটি দিক সম্পর্কে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
তারেক রহমান বলেন, ২০২৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হার ছিল সর্বনি¤œ। অপরদিকে পরীক্ষায় দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীও পাশ করতে পারেননি। একটি দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো, সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে পাশ করতে পারেননি। ইংরেজির পর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী তথ্যপ্রযুক্তি অর্থাৎ আইসিটিতে অকৃতকার্য হয়েছেন। ইংরেজি এবং আইসিটির মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ে এভাবে অকৃতকার্য হতে থাকলে বর্তমানে ‘এআই’ যুগের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকা সম্ভব কিনা- এই প্রশ্নটিও রাখলাম।
তিনি বলেন, পলাতক লুটেরা বাহিনীর বেপরোয়া লুটপাটের পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দেশের কমপক্ষে ২৪টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ নয়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৬ পার্সেন্ট। এরপর আর কোনো সরকারের পক্ষেই সেই রেকর্ড অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশেরও কম।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স- দেশে এই মুহূর্তে এই দুটি খাতই দেশের অর্থনীতির প্রধান ভরসার খাত। গত কয়েক মাসে রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীরাও বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি স্থিতিশীল সরকার। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা শর্ত দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ একদিকে নির্বাচন না করেই রাষ্ট্রযন্ত্রে খবরদারির সুযোগ গ্রহণ করা, অপরদিকে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম করা। পলাতক স্বৈরাচারীর সহযোগীরা গত কয়েকদিন খোদ রাজধানীতে যেভাবে আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটি একটি সতর্কবার্তা হতে পারে বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, এটি এখন সবার কাছেই স্পষ্ট ফাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একটি দল ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে ফ্যাসিবাদীদের ছাতার নিচে আশ্রয় নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিল। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচার একইভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলটির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে কিনা- এ ব্যাপারে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, দেশ এবং জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জনসমর্থিত দল হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রাখার ব্যাপারে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে। এটি কথার কথা নয়, এটি প্রমাণিত সত্য। রাজনৈতিক ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি অধিকাংশ পয়েন্টেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার, জুলাই সনদে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে বিএনপি এসব অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে কোনো রাজনৈতিক দল যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল পেয়ে যা ইচ্ছা তাই আদায় করে নিতে চায় কিংবা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিনা- সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের রাজপথের সঙ্গীদের প্রতি আহ্বান, অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে করবেন না।
অনুষ্ঠানে দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে একটা সংকট তৈরি করা হয়েছে, সেটা অপ্রয়োজনীয় সংকট। সেটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি মনে করি- এই সংকটটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে সংস্কারের জন্য যে নির্বাচন হওয়া দরকার সে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করা এবং জনগণের ভবিষ্যৎকে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলার জন্যই এ সংকট তৈরি করা হয়েছে। আসুন, আমরা সবাই একমত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব চক্রান্ত রুখে দিই। বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উত্তরণের পথ সুগম করি।
অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম এবং অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব, এলডিপি চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসান মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানউল্লাহ, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণফোরামের সভাপতি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী এবং জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখ।