নিষিদ্ধের ব্যাপারে অন্তর্র্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টালবাহানা দেখা যাচ্ছে
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কার করার দাবি উঠেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির বিক্ষোভ সমাবেশে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে অন্তর্র্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টালবাহানা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হবে, এই সিদ্ধান্ত জনগণ গত বছরের ৫ আগস্টই দিয়েছে। এরপরও কেউ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে জুলাই যোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করবে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা এ ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ এনে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সমাবেশ করে দলটি ।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে আমাদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে, এটা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা। বিচার ও সংস্কারের জন্যই মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। তিনি বলেন, জাতির কাছে আমাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল বিগত ফ্যাসিবাদী আমলের বিচার নিশ্চিত করা এবং দেশের সংস্কার করা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ’২৪এ প্রথমবার রাজপথে নেমে আসেনি, জীবন দেয়নি। এর আগে বহুবার এ দেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে জীবন দিয়েছে। ১৯৭১ সালের পরে ১৯৭২ সালে আমার সোনার বাংলার স্বপ্ন মুজিববাদীদের হাতে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। দেশটাকে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশের আকাক্সক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছিল। মুজিববাদী সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছিল। সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র নামে বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল।
আমরা দেখেছি বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছিল। দেশের জনগণ নব্বইয়ে রাজপথে নেমে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু ৩০ বছর পরে আবারও সেই স্বৈরতন্ত্র ফিরে এসেছিল। আমরা সবাই জানি বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে।
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতা যখন তাদের অধিকারের জন্য রাজপথে নেমে এসেছিল, এ দেশের পুলিশ সেনাবাহিনী বিজিবিকে দিয়ে গুলী চালিয়েছিল। আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। নিবন্ধন বাতিল করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। বিগত নয় মাসেও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমরা দেখছি যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, তারা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। মামলা-বাণিজ্য করা হচ্ছে। তৃণমূলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করেছে, বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখে না। অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, আগের মতো সুশীল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আপনারা না। আপনারা গণঅভ্যুত্থানের সরকার। গণঅভ্যুত্থানের ম্যানডেট নিয়ে আপনারা সরকারে বসেছেন।
তিনি বলেন, আপনাদের কাছে প্রশ্ন, যে আওয়ামী লীগ গণহত্যা চালিয়েছে সে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধা কোথায়? সেই ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আওয়ামী লীগের নামে মুজিববাদী আদর্শের নামে বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি চলতে পারে না।
জুলাই আন্দোলনের শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধ বলেন, আমরা এই দেশে আওয়ামী লীগকে আর ফেরত চাই না। আমরা শুনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে রাজনৈতিক দলের মতামত লাগবে, আমি বলি না। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত এই দেশের জনগণের। এই সিদ্ধান্ত জুলাইয়ের শহীদের মা বাবাদের, আহতদের। আমাদের পানির তৃষ্ণা এখনও মিটে নাই। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের মাধ্যমে আমাদের তৃষ্ণা মিটবে। সমাবেশে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগসহ দলটির সব অঙ্গ সংগঠনের নিষিদ্ধ করতে হবে। বিচার করতে হবে। তাদের আর এই দেশের জনগণ দেখতে চায় না। তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা নির্বাচন চাই না।’ এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসউদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করবে কি না, এই সিদ্ধান্ত অন্তর্র্বর্তী সরকারের নয়, কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবে শহীদদের পরিবার।’
দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘শহীদদের মায়েরা দাবি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিচারের আগে যেন কোনো নির্বাচন না হয়। আমাদের আহত ভাইরা জানিয়েছেন, আওয়মী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত যেন কোনো নির্বাচন না হয়। সমাবেশে বক্তব্যে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম বলেছেন, গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে অন্তর্র্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা টালবাহানা দেখতে পাচ্ছি, এটা লজ্জাজনক। আমাদের হাইকোর্ট দেখাবেন না। হাইকোর্ট দেখে জুলাই বিপ্লব হয়নি। আওয়ামী লীগকে কেন নিষিদ্ধ করা হবে না, তা জুলাই প্রজন্ম জানতে চায়- উল্লেখ করে তারিকুল আরও বলেন, অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে তারা কোনো আমলাতন্ত্রিক জটিলতা দেখতে চান না। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আগে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচনে যেতে হবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন বলেন, খুনি হাসিনাকে আমরা বিদায় করেছি। এই বিজয় আমাদের ধরে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগ আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দীন মাহাদী বলেন, খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে এনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে হবে। এ ছাড়া মৌলিক সংস্কার ছাড়া আবারও একটি নির্বাচনের দিকে যাওয়া হলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে গাদ্দারি করা হবে। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক মুজাহিদ বলেছেন, আমাদেহ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আওয়ামী লীগ ও হাসিনার দোসররা হুমকি। এরা বাংলাদেশে থাকতে পারে না।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব হুমায়রা নূর বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর দেশের মানুষকে শোষণ করেছে। দেশের মানুষকে তারা ভোট দিতে দেয়নি। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্য অবশ্যই দুর্নীতিপরায়ণ, খুনি-গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দিল্লির ‘প্রেসক্রিপশনে’ বাংলাদেশ আর চলবে না। অন্তর্র্বর্তী সরকারের উদ্দেশে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মাহিন সরকার বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে ন্যূনতম টালবাহানা করবেন না। মৌলিক সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন নয়। দলের যুগ্ম সদস্যসচিব তাহসীন রিয়াজ বলেন, আগামীর রাজনীতি হবে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে ছুড়ে ফেলার রাজনীতি। যে সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে, তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার রাজনীতি। এনসিপির সংগঠক রফিকুল ইসলাম আইনী বলেন, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হতে হবে। এটাই হবে এই সরকারের অন্যতম সংস্কার।
দলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আলী নাছের খান বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলবে কি চলবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এনসিপির সংগঠক মোস্তাক আহমেদ শিশির বলেন, এই দেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে, সেই সিদ্ধান্ত জনগণ ৫ আগস্টই দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হলে জুলাই যোদ্ধারা তা প্রতিহত করবে। সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। দলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দার বলেন, বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। সংস্কারের আগে কোনো জাতীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
কয়েকটি দল এনসিপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ করে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আতাউল্লাহ অবলেন, এনসিপির বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করবে, তারা শেষ হবে। এনসিপির একজন কর্মী জীবিত থাকতে বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ খালেদ সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসানও সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমার ছেলের বুকে ৭০টা গুলী করা হয়েছিল। একটা মানুষকে মারতে কত গুলী করতে হয়? হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তার দোসরদের কোনো স্থান হবে না।
মঞ্চে নামায আদায়
সমাবেশ চলাকালে আসরের নামাযের সময় হলে মঞ্চেই নামায আদায় করেন দলটির নেতারা। নামাযে ইমামতি করেন দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন। এর আগে বিকাল ৩টায় সমাবেশ শুরু হয়। নামাযে অংশ নেন এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদসহ অন্যান্য নেতারা।
এর আগে জুমার নামাযের পর থেকেই সমাবেশস্থলে মিছিল নিয়ে আসতে শুরু করেন দলটির নেতাকর্মীরা। এসব মিছিলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।