জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি ও তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন জুলাই বিপ্লব শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া জাতীয় নির্বাচন হতে দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানিয়েছেন তারা। এতে শহীদ ও আহত ৩০ শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা আলহাজ শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া।
জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি বাস্তবায়নে শহীদ ও আহত পরিবারের সম্মিলিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশকে এগিয়ে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমেছেন, আহত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে নতুন একটি বাংলাদেশের স্বাদ পেয়েছি আমরা। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান এখনও রাষ্ট্রীয় ও আইনি মর্যাদা পায়নি, জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা ও অধিকার এখনো সুনিশ্চিত হয়নি। আমাদের জাতির জন্য এক অপমানজনক বাস্তবতা।
তারা বলেন, এই বিপ্লবী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার মাধ্যমে সেই যোদ্ধাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় অতিক্রম হওয়া সত্ত্বেও এই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। যা এই বিপ্লবের অর্জনকে ঝুঁকিতে ফেলছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন থেকে সরে এসে শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এটি বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত। তাই অতিদ্রুত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, জুলাই বিপ্লবের প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সেটি এখনো করা হয়নি। এটি আমাদের জন্য অপমানের, সেই সঙ্গে বিপ্লবকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে জাতির বীর সন্তানদের সুরক্ষা। বিপ্লবের অর্জনকে সফলতায় রূপ দিতে হলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি অবধারিত। আমার একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজ জুলাই সনদের জন্য সংবাদ সম্মেলন করতে হচ্ছে। এটি অত্যন্ত বেদনার। আমরা চাই জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন করতে হবে, এরপর নির্বাচন?’
এ সময় মীর মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের যে আকাঙ্খা ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি বলেই জুলাই বিপ্লব হয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পরও এদেশ ঠিক হয়নি৷ স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই এ বিপ্লব। আমরা চাই, দেশে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, সেটি যেন আর না হয়। হাসিনা না পালালে আমরা হয়তো গুম, খুনের শিকার হতাম। তার পতনের মাধ্যমে প্রাথমিক বিজয় হয়েছে। আগামী দিনে যাতে নতুন করে রাস্তায় জীবন দিতে না হয়, সেজন্যই সংস্কার ও বিচার করতে হবে। শহীদ ও আহতদের স্বীকৃতি দিয়ে সনদের আইন ভিত্তি দিতে হবে। তাদের মর্যাদা ও সুরক্ষার জন্যই এটি করতে হবে এবং তা নির্বাচনের আগেই দিতে হবে।’
শহীদ আফিকুল ইসলাম সাদের বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, শহীদের রক্তকে মারিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। যার মূল কাজ হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা। কিভাবে এটি বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সরকার কমিশন করে একটি বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু এখন বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলো একে-অপরের ওপর কাদা ছোড়াছুড়ি করছে। জুলাই সনদ নিয়ে তারা যা করছে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত।
শহীদ শেখ ফাহমিন জাফরের মা কাজী লুলুল মাহমিন বলেন, আমরা জুলাই সনদ এখনো বুঝে পাইনি। সন্তানকে ছেড়েছি দেশের জন্য, কিন্তু এটির আইনি ভিত্তি না পেলে আমরা কোথায় যাব। আমাদের শহীদ পরিবার বিভিন্ন জায়গায় হয়রানির শিকার হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা বিদেশে যাবে, কিন্তু আমাদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কাজেই দ্রুত জুলাই সনদের আইন ভিত্তি দিতে হবে এবং অবশ্যই তা নির্বাচনের আগে।
শহীদ মোহাম্মদ মাহামুদুর রহমান খানের স্ত্রী মরিয়ম খানম বলেন, তিনটা বাচ্চা নিয়ে বর্তমানে জীবনযাপন করছি। আমাদের এখানে আসতে হবে সেটা ভাবিনি। আমরা সুরক্ষা, নিরাপত্তা চাই। নির্বাচনের আগেই অধ্যাদেশ কিংবা গণভোটের মাধ্যমেই হোক, অবশ্যই জুলাই সনদের আইন ভিত্তি দিতে হবে।
শহীদ মো. আব্দুল হান্নান খানের ছেলে ড. সাইফ আহমেদ খান বলেন, স্বৈরাচার হাসিনার শাসনামল থেকে কত মানুষ চোখের সামনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নতুন করে স্বাধীনতা দিয়েছে। আমার বোনের সামনেই পুলিশ আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। আমরা চাই, জুলাই সনদ অতিদ্রুত সংবিধানে যুক্ত করা হোক। যাতে আমরা সুরক্ষা পাই।
শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিনের বাবা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, বর্তমান সরকার অনেক দিন ধরে জুলাই সনদ নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু আজও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এখন সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। দেশের পরিস্থিতি আগের অবস্থার মতই চলছে। মুদ্রার এ পিট-ওপিঠ, কোনো পরিবর্তন নেই। নিশ্চয়ই এটি দেখার জন্য আমাদের সন্তানরা জীবন দেয়নি। অচিরেই আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই।
শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন বলেন, স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পর বড় দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। কিন্তু সনদ বাস্তবায়নে তাদের তেমন তৎপরতা নেই। যাদের রক্তের বিনিময়ে জুলাই বিপ্লব হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নসহ জুলাই যোদ্ধা ও পরিবারের আইনি সুরক্ষা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে শহীদ পরিবারের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। আমরা কোটা চাইনা কিন্তু একবারের জন্য হলেও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ নির্বাচনের আগে আইনি ভিত্তি না দিলে সেটির কোনো মূল্য থাকবে না। আগে সনদ পরে নির্বাচন করা হোক। না হলে একটা সময় আমাদের সন্তানদের জঙ্গি বানানো হবে।
শহীদ সৈয়দ মুনতাসীর রহমান আলিফের বাবা সৈয়দ গাজীউর রহমান বলেন, আমার একমাত্র ছেলে আন্দোলনের শুরু থেকে ছিল, একদিন রক্তাক্ত অবস্থায় বাসায় ফেরে। পরে তাকে যেতে নিষেধ করি। তার কথা ছিল দেশ স্বাধীন না হলে ফিরে আসব না। মামলা করেছি এখন পর্যন্ত একজন আসামি ধরেনি ৷ তাহলে বিচার কার করবে? এত বৈঠক, সনদ এগুলো তো আমাদের জন্য। এখন কথা বললেই সরকারের বিরুদ্ধে যায়, রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে যায়। হাসিনার মত লোকদের আনার জন্য তো এত মানুষ জীবন দেয়নি। এটা কী বিপ্লবের সরকার? কারা চালাচ্ছে দেশ? নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে কিছুই হবেনা। আমরা চাই বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন।