বিভক্তির কারণে সাংবাদিকরা নিজেরাই রাজনীতিকদের পকেটে ঢুকে যান বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) আয়োজিত মিডিয়া সংস্কার প্রতিবেদনের পর্যালোচনা শীর্ষক এক সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমকর্মী সাংবাদিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, আপনাদের তো অনেকগুলো ইউনিয়ন আছে। বিএফইউজে, ডিআরইউ, আবার দুই দলের দুই ভাগ আছে, তিন ভাগ আছে। আপনারা নিজেরাই আজ দলীয় হয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের কাউকে পকেটে নিতে চায়। আপনারা যদি পকেটে ঢুকে যান, তখন কিন্তু সমস্যা। আমরা দেখছি তো, গত ১৫ বছর কী হয়েছে। গত ১৫ বছর সাংবাদিকরাই উদ্যোগী হয়ে ফ্যাসিজমকে সমর্থন করেছেন।

বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হকের সভাপতিত্বে এবং সদস্যসচিব ইলিয়াস হোসেনের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিজেসির নির্বাহী মিলটন আনোয়ার। বিজেসির ট্রাস্টিদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন তালাত মামুন ও ফাহিম আহমেদ। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করে বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের প্রতিশ্রুতি খুবই পরিষ্কার। আমরা ৩১ দফার মাধ্যমে স্পষ্ট করে বলেছি যে আমরা একটি স্বাধীন গণমাধ্যম দেখতে চাই এবং সেটি গড়ে তুলতে চাই। সেজন্য আমরা তখনই একটি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করেছিলাম। আমরা আশা করি, আমরা যদি জনগণের ভোটে সরকার গঠনের দায়িত্ব পাই, তাহলে নিঃসন্দেহে এ বিষয়টি অগ্রাধিকার দেব।

গত ১৫ বছর অনেক সাংবাদিক নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সাংবাদিকদেরও অঙ্গীকারের প্রয়োজন আছে, তারা সেই জায়গা থেকে নিজেরা বাইরে থাকবেন এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা করবেন। তিনি বলেন, বিএনপি যখনই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, তখনই গণমাধ্যমকে উন্নত ও উপযোগী করে তোলার জন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যম। প্রায় ৪ মাসের আলোচনা শেষে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশ, তা নিয়েও আছে নানা পর্যবেক্ষণ।

মির্জা ফখরুল বলেন, সংস্কার যদি হৃদয়ে ধারণ না করা হয়, মনের মধ্যে না নেওয়া হয়, পরিবর্তন করতে না চাওয়া হয়, তাহলে কতটুকু সংস্কার করা সম্ভব হবে, সেটি জানা নেই। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। চারটি পত্রিকা ছিল যেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলেছে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে একটা মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদপত্রের ব্যবস্থা করেছেন। পরবর্তীকালে বিএনপি যখনই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসেছে, তখনই গণমাধ্যমকে উন্নত বা উপযোগী করে তোলার জন্য অনেক ব্যবস্থা নিয়েছিল।

জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। তিনি বলেন, গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হলেও, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অতীতের কোনো সরকার নিশ্চিত করেনি। বরং সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে আইসিটি আইন নামে একটি কালো আইন তৈরি করা হয়েছে। সাংবাদিকদের মামলা-হামলা দিয়ে জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মদদে সাংবাদিক সাগর-রুনিকে হত্যা করা হলেও আজ পর্যন্ত সেই হত্যাকা-ের তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করা হয়নি।

তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমকর্মী সাংবাদিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। সাংবাদিকদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার সৎ সাহসিকতা বজায় রাখতে হবে।

বিএনপিকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করা হলেও শেষ পর্যন্ত মানুষ এ দলকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে বলে মনে করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরের জন্য কারা দায়িত্ব পাবেন, বোঝা যায় তো নাকি? আমি জানি না। আপনারা হয়তো বলতে চাইবেন না। আমি বলি, আমার তো মনে হয়...আমি কোনো বিএনপির পক্ষে ক্যাম্পেইন করি না, আমি তো বিএনপি করি না। কিন্তু আমার মনে হয়, অনেক ক্রিটিসিজমের (সমালোচনা) পরও শেষ পর্যন্ত মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে।

সাংবাদিকদের ওয়াচডগের ভূমিকায় থাকতে হবে উল্লেখ করে মান্না বলেন, সাংবাদিকেরা শুধু ওয়াচডগ নন, তারা মাঝেমধ্যে পথপ্রদর্শকও হতে পারেন। যারা সাংবাদিকদের দাবিগুলো পূরণ করার অঙ্গীকার করবে, তাদের পেছনেও সাংবাদিকদের ওয়াচডগের মতো থাকতে হবে। তবে সাংবাদিকদের দাবিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে না জানিয়ে পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদের কাছেই বলার পরামর্শ দেন নাগরিক ঐক্যের এই নেতা।

সেমিনারে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন গণমাধ্যম কার্যালয়ের ভেতরে রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে বিজেসি আট দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। এগুলো হচ্ছে সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন, একটি স্বাধীন জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন, টিভি চ্যানেলগুলোকে পে-চ্যানেল ঘোষণা করা ও সম্প্রচারমাধ্যমকে শিল্প ঘোষণা এবং সম্প্রচার সাংবাদিকদের জন্য জবাবদিহিমূলক ‘কোড অব এথিকস’ প্রণয়ন, টিভি লাইসেন্স নীতিমালা ও মালিকানার ধরন নির্ধারণ, পরিচালনা পর্ষদে কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মতো কাঠামোগত সংস্কার, স্বাধীন অ্যাক্রেডিটেশন কর্তৃপক্ষ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সাংবাদিকতার নীতিমালার প্রণয়ন ইত্যাদি। গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশ ও সাংবাদিকদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তায় পড়ে আছে বলে উদ্বেগও জানিয়েছে বিজেসি। এই সুপারিশগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরবে এবং দ্রুত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেবে বলে প্রত্যাশা করে বিজেসি। অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ছাড়াও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের উন্নয়নে কাজ করা দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। মতবিনিময়ে বিগত সময়ে গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক অবস্থানের সমালোচনা করেন রাজনীতিকেরা।