“আমরা সবাই হাদী হবো, যুগে যুগে লড়ে যাবো” লাখো মানুষের এমন স্লোগান শুনতে শুনতে দুনিয়ার সফর শেষ করে চিরবিদায় নিলেন জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ বীর শরিফ ওসমান হাদী। চিরশায়িত হলেন বাংলাদেশের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে। বীরের বিদায় বুঝি এমন-ই হয়। ওসমান হাদীর চিরবিদায়কে কেন্দ্র করে লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা এবং মানিকমিয়া এভিনিউসহ আশপাশের সব এলাকায়। “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার” স্লোগান উঠেছিল লাখো কন্ঠে। গোলামির জিঞ্জির ছিঁড়ে আজাদি’র সুর তুলেছিল সবাই। তার শেষ বিদায়ে কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন উপস্থিত সবাই।
বাংলাদেশের বুকে ইনসাফ কায়েমের আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন ৩৪ বছর বয়সী শরিফ ওসমান হাদী। হাদীর আন্দোলন, হাদীর জীবনাচার, তার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে ধারণ করেই সারাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ হাজির হয়েছিলো মানিকমিয়া এভিনিউতে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আশপাশের এলাকা ও রাস্তাঘাটে তৈরি হয় মানব¯্রােতের। জানাযা শেষে সেই ¯্রােত গিয়ে মিশে ফার্মগেইট, কাওরানবাজার, বাংলামোটর হয়ে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে।
ওসমান হাদীর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল তার কন্ঠে আবৃত্তি করা বিদ্রোহী কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা- বল বীর- বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির! এই চেতনাকে ধারণ করেই জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন শরিফ ওসমান হাদী। সেই চেতনার আলোকে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আগ্রাসী ও ফ্যাসিবাদী কালচারকে প্রতিরোধ করতেই তৈরি করেন ইনকিলাব মঞ্চ। সেই ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হাদীকেই গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ কমপ্লেক্সে থাকা জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে দাফন করা হয় । জুলাই বিপ্লবের এই অগ্রনায়ককে দাফন করার পর তার সমাধির ওপর সমাধি লিপি লেখা হয়। লিপিতে লেখা হয়, ‘আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদী। (১৯৯৩-২০২৫)। শাহাদাত : ১৮ ডিসেম্বর-২০২৫।’
শহীদ শরীফ ওসমান হাদীর দাফনের মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক সাহসী কণ্ঠ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেও তার প্রতিবাদী কণ্ঠ ও সংগ্রামের স্মৃতি দেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অম্লান থাকবে।
বিপ্লবী শরিফ ওসমান হাদীর মুল্যায়নটা শোনা যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সন্তানকে বুকে নিয়েছে। মা তার সন্তানকে আবার ফেরত পেয়েছে। আমরা তার জন্য দোয়া রাখি।
ভিসি বলেন শহীদ হাদির পরিবারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সম্প্রসারিত পরিবারের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। আমরা মনে করি, তার পরিবার আজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় পরিবারেরই অংশ। এই কঠিন সময়ে ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে যে সহযোগিতা তারা করেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানটি কেবল একটি দাফনস্থল নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর একটি প্রতীক। আপনারা জানেন, এখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি রয়েছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একাধিক সন্তানও এখানে শায়িত আছেন। এই স্থানে শহীদ হাদিকে দাফনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সন্তানের প্রতি সম্মান জানিয়েছে। তিনি এ সময় আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানসহ- যারা দাফন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করেছেন- সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদের মর্যাদা আলাদা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে শহীদের যে বিশেষ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিফলন আমরা আজ এই আয়োজনের মধ্যেও অনুভব করেছি। দাফনকালে উপস্থিত ছিলেন- আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ডাকসু প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় শহীদ হাদীর দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। দাফনের আগে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাযা শেষে ওসমান বিন হাদীর লাশ দাফনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে আনা হয়। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। উপস্থিত সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। লাশবাহী গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটতে থাকে মানুষ। সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ গাড়ির ওপরে উঠে বসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে এই জুলাই বিপ্লবীর লাশ এসে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এস এম ফরহাদ, এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবেরসহ তার অনেক সহযোদ্ধা ও জুলাইয়ের প্রথম সারির বিপ্লবী।
বিপ্লবী হাদীর লাশ কবরে নামান মাহমুদুর রহমান, সাদিক কায়েম, হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্যরা। এ সময় আরেকবার কান্নার রোল পড়ে যায়। সবাই অশ্রুসিক্ত নয়ন আর ভগ্ন হৃদয়ে শহীদ হাদির লাশ কবরে রাখেন। দাফন শেষে মোনাজাত পরিচালনা করেন শহীদ শরীফ ওসমান হাদীর বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। এ দফায় হাদির ভক্তদের কান্নায় ভারি হয়ে যায় ঢাবির পরিবেশ। কাঁদতে কাঁদতে প্রিয় সহযোদ্ধার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন উপস্থিত জনতা।
জানাযায় জনতার ¯্রােত
গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে শহীদ ওসমান হাদীর নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিকের ইমামতিতে এ জানাযা আদায় করা হয়। এসময় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া এভিনিউ জুড়ে আবেগ ও প্রতিবাদের মিশ্র চিত্র দেখা গেছে। কেউ হাদীর মৃত্যুতে অশ্রুসিক্ত হন, আবার কেউ ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন এবং হাদী হত্যার বিচার দাবি করেন।
জানাযায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলসহ উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাযার আগে হাদির জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। এরপর বক্তৃতা দেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের। এরপর বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর পরপরই পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দেন হাদীর বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। বড় ভাইয়ের বক্তৃতার সময় জানাযায় উপস্থিত অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তিনি হাদির জানাযায় ইমামতি করেন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান, বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং সর্বোপরি বিভিন্ন দল-মত ও শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাদির জানাযায় অংশ নেন।
শহীদ জানাযায় অংশ নেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন ও মোবারক হোসাইন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল এবং ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী প্রমুখ। অন্যান্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। এতে যোগ দেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ জানাজায় অংশ নেন।
সকাল ১১ টা ২০ মিনিটে খুলে দেওয়া হয় সংসদ ভবনের প্রধান গেট। পরে সংসদ ভবনের চারপাশ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আসাদগেট, ফার্মগেট ও খামারবাড়িসহ আশপাশের এলাকায় মানুষের ঢল নামে। এসময় তাদের ‘আমরা সবাই হাদী হবো, যুগে যুগে লড়ে যাবো’, ‘হাদী ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
বেলা ১২টা বাজার আগেই পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মানুষের ভিড় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বিশাল রাজপথ ছাপিয়ে ফার্মগেটের খামারবাড়ি ও আসাদগেট পর্যন্ত চলে যায়। উত্তর দিকে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্তও ছিল মানুষ আর মানুষ।
জানাযায় অংশ নিয়ে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, সারা বাংলাদেশ আজ কাঁদছে। তিনি বলেন, ওসমান হাদী শাহাদাৎ বরণ করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ তাকে যেন শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন। তার জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন আল্লাহতায়ালা মাফ করেন। আল্লাহ তার করবরকে জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দেন। ‘তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আদিপত্যবাদ বিরোধী একটা ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সে স্বপ্নের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে আপনি তৌফিক দান করুন। সারা বাংলাদেশ আজ কাঁদছে।’ উপদেষ্টা আরও বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দর।