গত বছর আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাতীয় অর্থনীতিতে যে বিরূপ আবহ বিরাজ করছিল তা অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠা গেছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে চাঙা হয়ে ঊঠছে জাতীয় অর্থনীতি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের ২৯ জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩০ দশমিক ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা দেশের ইতিহাসে যেকোনো অর্থবছরে সর্বোচ্চ। এই বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয়ের উল্লেখযোগ্য প্রবাহ। আবার এ সময় বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ৮২৮ কোটি ৩৯ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৪৬ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে জুনের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।
রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রেমিট্যান্স বাবদ ২০২৪ সালের শেষ ৬ মাসের আয় ছিল ১৩ হাজার ১১৩ মার্কিন ডলার। চলতি ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স আসে ৬ হাজার ৫৪৩ মিলিয়ন ডলার এবং দ্বিতীয় তিন মাসে আসে ৭ হাজার ২৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ৬ মাসের মোট আয় ১৩ হাজার ৭৭৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রথম ৬ মাসের চেয়ে শেষ ৬ মাসে বৃদ্ধি পায় ৬৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তথ্যে আরো জানা যায়, ২০২৩ সালের মোট রেমিট্যান্স আয় ছিল ২১ হাজার ৬১১ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালের আয় ছিল ২৩ হাজার ৯১০ মিলিয়ন ডলার। একক দেশ হিসাবে সর্বাধিক পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর পরে আছে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্য।
রফতানি থেকে আয় বৃদ্ধি
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ক্ষুদ্র-বৃহৎ আকারের পণ্য মিলিয়ে রফতানি পণ্যের সংখ্যা প্রায় একশো। এই খাত থেকে দেশ বিপুল পরিমাণ মুদ্রা আয় করে যা দেশের রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা যায়, এই রফতানি খাত থেকেও আয় বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৬৯ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪-২৫-এর জুলাই-মে মাসে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৯৪৬ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার। পূর্ববর্তী একই সময়ের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার শতকরা ১০ ভাগ। তথ্য মোতাবেক, এপ্রিলে খানিকটা ধীরগতির পর মে মাসে আবারো গতি ফিরেছিল দেশের পণ্য রফতানিতে। চলতি অর্থবছরের মে মাসে পণ্য রফতানিতে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটে। ইপিবি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে রফতানি আয় ছিল ৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। আর মে মাসে ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। সার্বিক চিত্রে দেখা যায়, পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় চলতি বছরের রফতানি প্রবৃদ্ধির শতকরা হার দাঁড়িয়েছে ১১ ভাগেরও বেশি।
রফতানির বড় একটি খাত তৈরি পোশাক। এই খাতেও সমৃদ্ধি এসেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জুন মাসে তৈরি পোশাক খাতে যেখানে আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৬১৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাসের মধ্যে রফতানি আয় ৮.৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলারে। এভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া রফতানি খাতগুলোর মধ্যে আছে, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, সিমেন্ট, লবণ, পাথর, রাবার, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্রকৌশল পণ্য, হোম টেক্সটাইল প্রভৃতি। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি পণ্য, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও হোম টেক্সটাইলের রফতানি বেড়েছে। হোম টেক্সটাইলের রফতানি আয় ২ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলারে। আর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত জুলাই-জুন মাসে রফতানি হয়েছে ১১৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়া কৃষি পণ্যের রফতানি আয় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ কোটি ৮৬ লাখ ডলারে।
রিজার্ভ সমৃদ্ধ হচ্ছে
রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বৃদ্ধির সুবাদে রিজার্ভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে জানা গেছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিও মজবুত হচ্ছে। তথ্যানুযায়ী, গত ৩০ জুন অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৬৮৩ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ২৬ হাজার ৬৬৩ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার আশা করছে, রেমিট্যান্স, রফতানি ও উন্নয়ন সহযোগীদের বাজেট সহায়তার কারণে ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ ৩৪ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে এই রিজার্ভে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং বেশ কয়েক মাস পরিস্থিতি ছিল টালমাটাল।
ভারতের বাণিজ্য-বাধা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ভারতের যে বাণিজ্য-প্রতিবন্ধকতা চলে আসছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। ভারতের বিধিনিষেধে বন্দরে বন্দরে আটকা পড়ছে বাংলাদেশি পণ্যের ট্রাকবহর।
সর্বশেষ গত মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সমুদ্রপথে একটি পথ খোলা রেখেছে ভারত। স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করা এসব বাংলাদেশি পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড়। বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এই ৯ ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছে ১৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে স্থলবন্দর দিয়ে রফতানি হয়েছে ১৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের পণ্য। অর্থাৎ এসব পণ্যের ৯৯ শতাংশই স্থলবন্দর দিয়ে রফতানি হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ আরোপ করলো ভারত। এর আগে গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল। সেসময় খাদ্যপণ্য নিয়ে ১৭টি ট্রাক বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওপার থেকে আমদানি বিধিনিষেধের কারণে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায় পণ্যগুলো পাঠানো সম্ভব হয়নি। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ভারতে রপ্তানির জন্য আনা প্রাণ-আরএফএলের গ্রুপের এক ট্রাক প্লাস্টিক পণ্য আটকে যায়। ট্রাকটিতে প্রায় ৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকার পিভিসি দরজা ছিল। যশোরের বেনাপোল বন্দরে আটকে যায় তৈরি পোশাকবাহী ৩৬ ট্রাক পণ্য। বিধিনিষেধের কারণে পণ্যের চালান ভারতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। সেসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতমুখী রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পর দিনভর এসব পণ্যের কোনো ট্রাক ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেনি।