জাতিসংঘের সব সূচক পূরণ করে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় উত্তরণের পথে বাংলাদেশ। এই অগ্রগতি সমৃদ্ধি ও সুযোগের এক নতুন যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এই আর্থিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বেড়েছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কম খরচ, দীর্ঘস্থায়ী ও সহজলভ্যতার কারণে আধুনিক জীবনে প্লাস্টিক একটি অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হচ্ছে।

সূত্র মতে, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। গত তিন দশকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বার্ষিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে দেশ। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে। এই অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোর উন্নয়ন, জীবনমানের উৎকর্ষ এবং মাথাপিছু আয়ে (২০২২ সালে ২,৬৮৭ ও ২০২৩ সালে ২,৫২৯ মার্কিন ডলার) উল্লেখযোগ্য উন্নতি এনে দিয়েছে।

এছাড়া রপ্তানি আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৩ সালে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যার সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাকখাত থেকে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। জাতিসংঘের সব সূচক পূরণ করে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ। এই অগ্রগতি সমৃদ্ধি ও সুযোগের এক নতুন যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের অব্যবস্থাপনা ফলে দেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে প্লাস্টিক অন্যতম।

চলতি বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করো’। এটি পৃথিবীর প্রতি দেশের সম্মিলিত দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি সুসংগঠিত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব দৃশ্যমান আবর্জনার বাইরেও বিস্তৃত। প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন পরিবেশগত উদ্বেগের কারণ তা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট, প্রকৃতি, ভূমি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির সংকটকেও আরও বাড়িয়ে তোলে। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য মোকাবিলা কেবল পরিবেশগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রচেষ্টা নয়, বরং বৃহত্তর জলবায়ু সম্পর্কিত কার্যক্রম এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র মতে, প্লাস্টিক দূষণের বৈশ্বিক সংকট বাংলাদেশে বিশেষভাবে স্পষ্ট। এই দূষণ সরাসরি শহরজীবনে প্রভাব ফেলছে। কারণ এর ফলে নর্দমা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়, গুরুত্বপূর্ণ জলাধারগুলো দূষিত হচ্ছে এবং বর্ষাকালে নগরজুড়ে পানিবদ্ধতা আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৫ বছরে শহরাঞ্চলে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে, যা ২০০২ সালে ছিল ৩ কেজি, ২০২০ সালে এসে দাঁড়ায় ৯ কেজিতে। শুধু ঢাকায় ২০২০ সালে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ২৫ কেজি, যা ২০০৫ সালের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি। তবে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়লেও কমেছে রিসাইক্লিং। ২০০৬ সালে যেখানে ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হতো, সেখানে ২০২০ সালে তা নেমে আসে ৩৭ শতাংশে। যদিও এটি বৈশ্বিক গড় ৯ শতাংশের চেয়ে অনেক ভালো। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের চাহিদা ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,

রিসাইক্লিংয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো ‘ফিডস্টকের গুণমান’ (রিসাইক্লিংয়ের জন্য পরিষ্কার প্লাস্টিক)। ঘরোয়া পর্যায়ে বর্জ্য পৃথক না করার কারণে অধিকাংশ প্লাস্টিক ভেজা আবর্জনার সঙ্গে মিশে যায়। ফলে সেগুলো রিসাইক্লিংয়ের আগে বহুবার ধোয়া লাগে। এতে পানি ও জ্বালানির অপচয় হয়, যা অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যেত। শুধু নাগরিকদের এই একটিমাত্র আচরণগত পরিবর্তন সমগ্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বদলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্জ্য সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ, দীর্ঘমেয়াদি জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও দায়িত্ব নির্ধারণের মাধ্যমে তারা একটি সুষ্ঠু কাঠামো গড়ে তুলতে পারে।

দ্বিতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কাঁচামালের ঘাটতি। দেশে বছরে প্রয়োজন প্রায় দুই লাখ টন প্লাস্টিক স্ক্র্যাপ অথচ সরবরাহ মাত্র ৭০ হাজার টন। এটি সংগ্রহ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ভোক্তাদের সচেতনতার অভাব।

তৃতীয় সমস্যা হলো এখাতের অনানুষ্ঠানিকতা। প্রায় ৯০ শতাংশ রিসাইক্লিং ব্যবসা অনানুষ্ঠানিক। যার ফলে তদারকি, অর্থায়ন এবং ব্যবসার প্রসারে বড় বাধা সৃষ্টি হয়।

তাছাড়া বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য সংগ্রহখাতের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে তারা বর্জ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সুবিধার অভাবযুক্ত একটি বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক কর্মীবাহিনীর ওপর এই নির্ভরতা সামাজিক ন্যায্যতার চ্যালেঞ্জ ইঙ্গিত করে।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি কারক প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করে থাকে। তারা প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করে সেগুলোকে ব্যবহার পণ্যে পরিণত করে।

এর মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৮০০-৯০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়।

এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, শুধু শিল্পখাতের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সরকার, শিল্প, সমাজ ও প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা যেমন ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া উচিত। শুরুর দিকে এই নিষেধাজ্ঞা আশাব্যঞ্জক সাড়া ফেললেও দুর্বল বাস্তবায়ন ও পর্যাপ্ত বিকল্পের অভাবে তা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকেনি।

তিনি বলেন, এই অভিজ্ঞতা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের মুখোমুখি করে। অর্থাৎ সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প ছাড়া প্লাস্টিক পণ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বাস্তবে টেকসই হয় না বরং এটি অনানুষ্ঠানিক খাতে অসমতা বাড়ায়। এই জটিলতাগুলো স্বীকার করে আমরা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী, সহযোগিতামূলক এবং টেকসই পদ্ধতির অবলম্বন করতে পারি। তাছাড়া ব্যক্তি এবং ব্যবসা উভয়ের জন্যই প্লাস্টিক হ্রাস ও দায়িত্বশীল ব্যবহারের মৌলিক নীতিগুলো গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে ভোক্তাদের উচিত সক্রিয়ভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে আলাদা করা ও রিসাইক্লিং উদ্যোগে অংশগ্রহণ করা।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ) এর সভাপতি শামীম আহমেদ দৈনিক সংগ্রাম কে বলেন, প্লাস্টিককে টেকসই পণ্য হিসেবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্যই মূলত প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। বর্তমানে ধাতু, স্টিল, গ্যাস, কাঠ, গ্লাস ও কাগজের মতো উপকরণের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিক। এতে পরিবেশের ওপর চাপ অনেক কমেছে। আমেরিকান কেমিস্ট্রি কাউন্সিল বলছে, যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণ শিল্পে প্লাস্টিক ইনসুলেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বছরে ৪৬৭ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বিটিইউ (ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট) শক্তি সাশ্রয় করছে। এ প্রযুক্তি বিল্ডিংয়ে তাপ ও ঠাণ্ডা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে বিদ্যুৎ খরচ কম হয়, যা প্রকারান্তরে কার্বন নিঃসরণ কমায়। অটোমোবাইল শিল্পে প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। গাড়ির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। এতে গাড়ির ওজন কমিয়ে জ্বালানি সাশ্রয় এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে। প্লাস্টিক ব্যাবহার করে গাড়ীর ওজন ১০% কমালে জ্বালানি অর্থনীতির ৬ থেকে ৮% উন্নতি করা যায়।

ডিবিএল গ্রুপের চিফ সাসটেইনিবিলিটি অফিসার জাহিদ উল্লাহ বলেন, প্লাস্টিক নয়, আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো দূষণ। প্লাস্টিককে কেবল একটা সস্তা এবং পরিবেশ দূষণকারী পণ্য হিসেবে দেখলে হবে না। বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক একটি উচ্চমূল্য সম্পন্ন পণ্যে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য উন্নত দেশে দেখা যায়, সেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে উদ্ভাবনমূলক কাজ হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, গাড়ি, বিমান ইত্যাদির উৎপাদনে। তবে প্লাস্টিকের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হঠাৎ করে আমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট এসইউপি পর্যারক্রমে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। উপযুক্ত বিকল্প ছাড়া প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বন্ধ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।