খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়া একসময় ছিল সোনার ফসলের মাঠ। ধান, শাকসবজি, পাট, ডাল সবকিছুই ফলতো এই উর্বর জমিতে। কিন্তু এখন সেই চিত্র অতীত। অতিবৃষ্টির কারণে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা এমনভাবে বেড়েছে যে কৃষকের মাঠে আর ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। জমির বুকজুড়ে জমে থাকা পানি এখন মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে হাতের লাঙল ফেলে ধরেছেন জাল আর ঘুনি।
কৃষ্ণনগর গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী পরমানন্দ মল্লিক একসময় ছিলেন কৃষক, এখন মৎস্যজীবী। নিজের দুই একর জমিতে ধান চাষ করে সংসার চলত মোটামুটি। কিন্তু গত কয়েক বছরের অতিবৃষ্টিতে বিল ডাকাতিয়া এলাকা ডুবে থাকে প্রায় সারা বছরই। ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, মাছও ভেসে গেছে। এখন তিন সদস্যের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। পরমানন্দের কথায়, জমি আছে, কিন্তু কিছু ফলাইতে পারি না। এখন বিলের মাছই ভরসা। সকালেই জাল নিয়ে যাই, মাছ ধরি, বিকেলে কৃষ্ণনগর আড়তে বিক্রি করি। যা পাই, তাই দিয়ে সংসার চলে। পরমানন্দের মতো একই অবস্থায় পড়েছেন গ্রামের অনেকেই। শিবপদ বালা (৫৬), ধ্রুব মণ্ডল (৪৫), অজিত বালা (৭০) সবাই কোনো না কোনোভাবে জাল বুনছেন, ঘুনি বানাচ্ছেন, কিংবা মাছ বিক্রির কাজে লেগে আছেন। কৃষকের গ্রাম এখন একরকম মৎস্যজীবী গ্রামে পরিণত হয়েছে। আগে মাছ ধরা কাজটি অনেকের চোখে ছিল তুচ্ছ । কিন্তু এখনসেই সামাজিক ভেদাভেদ মিলিয়ে গেছে পেটের দায়ে।
বিল ডাকাতিয়া এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা তারক চন্দ্র মণ্ডল বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে ধান বা ফসল কিছুই উৎপাদন হচ্ছে না। জমি থেকে এখন আর কোনো লাভনেই। সবাই এখন মাছ ধরে বেঁচে আছে। আগে কে কৃষক, কে শ্রমিক, কে নেতা এখনসবাই এক। তারকের কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সামাজিক বাস্তবতা। বন্যা, জলাবদ্ধতা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানুষকে নতুন জীবনধারায় ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাও এখন মাছ বিক্রির ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে সকাল সকাল বাজারে ছুটছেন। এই রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলাকার নারীরাও।
কৃষ্ণনগর গ্রামের অনামিকা মল্লিক (৩৮) প্রতিদিন সকালে কৃষ্ণনগর মৎস্য আড়তে মাছ বাছাই ও সংরক্ষণের কাজ করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে পান ৪০-৫০ টাকা। অনামিকা বলেন, আগে স্বামীর কৃষিকাজেই সংসার চলত, এখন আমি না কাজ করলে সংসার চলে না। এক সময় গ্রামীণ নারীরা মাঠের কাজ বা মাছের আড়তে কাজ করাকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু এখন নারীরাও পরিবার চালাতে পুরুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সমাজে এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, নারীর ভূমিকার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনছে।