রাজশাহী অঞ্চলে বসতবাড়ি নির্মাণ ও ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত পুকুর খননের কারণে চাষযোগ্য জমির ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে প্রতিবছরই কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে গত ছয় বছরে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমশই কমছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে রাজশাহীতে কৃষিজমি কমেছে প্রায় ৫ হাজার ২৮৯ একরের মতো। কৃষি উৎপাদন নির্ভর এই অঞ্চলে জমি কমে যাওয়াকে কৃষিবিদরা ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে রাজশাহীতে মোট কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭০৫ একর। পরের বছর ২০২১-এ তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৯১০ একর। ২০২২ সালে এই পরিমাণ আরও কমে হয় ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৭৬১ একর। ২০২৩ সালে নেমে আসে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৮ একরে এবং ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯১ একর। চলতি বছর ২০২৫ সালে কৃষিজমির পরিমাণ আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪১৬ একরে।
প্রাপ্ত তথ্যনুযায়ী প্রতিবছরই কমেছে কৃষি জমি। আর বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছে এভাবে কৃষি জমি কমতে থাকলে হুমকির মুখে পড়তে পারে রাজশাহীর কৃষি ও অর্থনীতি। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, গত কয়েক বছরে রাজশাহীর বিলগুলোতে যে পরিমাণ পুকুর হয়েছে তার সবগুলোই তিন ফসলি জমিতে। কৃষি জমি রক্ষায় একটি আইন আছে, যেটিতে পুলিশ কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই খননকারীদের গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু পুলিশ সেটা করে না, তারা ইউএনওদের অপেক্ষায় থাকে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে তাই মানুষ শহর থেকে গিয়ে গ্রামে ফসলি জমি নষ্ট করে বসতবাড়ি নির্মাণ করছে। আমাদের সকলকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে একটি বাড়িতেই বহুতল ভবন নির্মাণ করার। এছাড়াও ইট ভাটায় বিলের জমি (টপ সয়েল) নষ্ট না করে পার্শ্ববর্তী নদী থেকে বালু উত্তোলন করে তা দিয়ে ইট বানানো যেতে পারে। এভাবে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেই কৃষি জমি রক্ষা পাবে বলে মনে করি।
এ বিষয়ে স্থানীয় কৃষকরা জানান, আবাসিক প্রকল্প, রাস্তা নির্মাণ এবং কাঠামোগত উন্নয়নের কারণে ফসলি জমি ধীরে ধীরে কমছে। কৃষকদের আক্ষেপ, জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, পাশাপাশি ফসল ফলানোর উপযোগী জমিও সংকুচিত হচ্ছে। রাজশাহীর কয়েকটি উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের সাথে কথা বললে তারা কৃষি জমি কমে আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কৃষকরা বলছেন, ১৫-২০ বছর আগেও এলাকায় কৃষিজমির পরিমাণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই সময় দিগন্তজোড়া কৃষিজমি চোখে পড়তো। এখন সে অবস্থা নেই। রাস্তাঘাট, আবাসন, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও পবায় কৃষি জমি নষ্ট করে যে পরিমাণ পুকুর খনন করা হয়েছে তাতেও প্রচুর পরিমাণ আবাদি জমি নষ্ট হয়েছে। আগে সড়কের দুদিকে শুধু কৃষিজমি দেখা যেতো। জমি অধিগ্রহণ করে রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি। এরমধ্যে তিন-চার ফসলি জমিও রয়েছে। কৃষি জমি রক্ষায় আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই জানিয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আবাসন-নির্মাণ, পুকুর খনন ও ইটভাটা স্থাপনের কারণে রাজশাহীতে আবাদি জমি কমছে। এছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ণেও এই সমস্যা বাড়ছে। আইনের প্রয়োগ ও প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া এই প্রবণতা থামানো কঠিন হবে। কৃষি জমি কমতে থাকলে ভবিষ্যতে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিজমি রক্ষায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে রাজশাহীর কৃষি খাত বড় ধরনের সংকট আসবে। বিপর্যয়ে পড়তে পারে এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি।