বিলকুমারী বিলের জলজ খাদ্যবৈচিত্র্য, বিলুপ্তপ্রায় ৪৫ ধানসহ ২৫০ দেশি জাতের ধান, বিভিন্ন প্রকার শাক প্রদর্শনী, কৃষিভিত্তিক ছড়া আবৃত্তি, পিঠাপুলি আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের নিভৃত গ্রাম রাজশাহীর তানোরের দুবইল গ্রামে এক ব্যতিক্রমী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এ গ্রামের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘লুপ্ত ধানের রক্ষক’ মরহুম কৃষক ইউসুফ মোল্লার বীজ ব্যাংক এবং পরিবেশবাদী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) এই উৎসবের আয়োজন করে। উৎসবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর মান্দা, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলায় জৈব কৃষি সম্প্রসারণে উদ্যোক্তা কৃষক, তানোরের সাহিত্য পরিষদের সংগঠকরা ও গ্রামের কিষাণ-কিষাণীরা অংশ নেন। গত শনিবার সেই দুবইল গ্রামটি ছিল অন্যরকম। খুব ভোরে সূর্য উঁকি দেয়ার আগেই গ্রামের প্রায় অর্ধশত কৃষক জাইদুরের বাড়ির উঠানে নতুন ধানের আটা দিয়ে পিঠাপুলি করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে পুরুষেরা জাল দিয়ে পুকুরে মাছ ধরতে নেমেছে। কেউ বড় বড় ডেগজিতে রান্না চাপাচ্ছে। দুবইল প্রাইমারি স্কুলের মাঠে আয়োজিত নবান্ন অনুষ্ঠানে লুপ্ত ধানের রক্ষক কৃষক জাইদুর রহমানের সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত নুর মোহাম্মদসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ। উৎসবের প্রদর্শনীতে বিলকুমারী বিলের জলজ ফল, তেলাকুচাসহ ২০ প্রজাতির অচাষকৃত শাক ও লুপ্ত ধানের মধ্যে রাঁধুনিপাগল, ঝিঙ্গাশাইল, দুধসর, জামাই সোহাগী, নারী পারিজাত, পিঁপড়ার চোখ, সোনামুখী, সোনাকাঠি, সাদাবোরা, কালাবোরাসহ ৪৫ প্রজাতির লুপ্ত ধান ও ২০০ শতাধিক প্রজাতির দেশি ধানের বীজ প্রদর্শন করা হয়। অতিথিদের লুপ্তপ্রায় ৩১ প্রকার ধানের পুরোনো চালের ভাত ও বিভিন্ন প্রকার পিঠাপুলি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। লুপ্ত ধানের রক্ষক জাইদুর রহমান বলেন, এমন উদ্যোগী হওয়া বড় কৃতিত্ব তার বড় ভাই ইউসুফ মোল্লার। ২০২২ সালে বড় ভাই ইউসুফ মোল্লা মারা যাওয়ার পর তার বীজভাণ্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি। আদর্শ কৃষক হিসেবে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন ইউসুফ মোল্লা। তার প্রচেষ্টায় বিলুপ্তি প্রায় ২৫০ বেশি ধানের বীজ তার বীজ ভাণ্ডারে সংরক্ষণে আছে। এতো রকম জাতের ধান একসঙ্গে চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কৃষক পর্যায়ে ইউসুফ মোল্লার বীজ ভান্ডাই প্রথম স্থানে আছেন বলে দাবি করেছেন কৃষক জাইদুর রহমান ও কৃষি কর্মকর্তারা। ব্যক্তি উদ্যোগে এসব বিলুপ্ত ধানের বীজ দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ আছে ইউসুফ মোল্লার বরেন্দ্র বীজ ভাণ্ডারে। ২০১২ সাল থেকে রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরসহ সারাদেশে প্রায় ৩০০ কৃষককে তিনি এসব বীজ শর্তসাপেক্ষে সবরাহ করেছেন। এছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকায় ১০০-এর বেশি ও রাজশাহী গবেষণাগারে প্রায় ৬৫ জাতের ধান বীজ সরবারহ করেছেন। উৎসবে ১৫ জন কৃষক নিজেদের মধ্যে ধানের বীজ বিনিময় করেন। এদিকে চাষের মাধ্যমে দেশি বীজ সংরক্ষণে অবদান রাখার জন্য একই অনুষ্ঠানে ৬ জন কৃষককে সম্মাননা দেয়া হয়। অংশগ্রহণকারী শাহানাজ বেগম জানান, বীজ ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা রাঁধুনীপাগল ও কালিজিরা ধানের বীজ নিয়ে তিনি জমিতে চাষ করবেন।