শফিকুল ইসলাম, গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর সমাজে জমির উর্বরতা ও ফলন বৃদ্ধির জন্য নানামাত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি উপকরণ হলো “ঘাস মারা বিষ” বা হার্বিসাইড। আগাছা দমন করতে এটি যেমন কৃষকের শ্রম ও সময় বাঁচায়, তেমনি সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে মাটির ক্ষয়, পরিবেশ দূষণ এমনকি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করে। তাই বিষয়টি এখন একদিকে আশীর্বাদ, অন্যদিকে অভিশাপের মতো দাঁড়িয়েছে।
ধান, গম, ভুট্টা, পাটসহ বিভিন্ন ফসলে ঘাস বা আগাছা জমে গেলে গাছের পুষ্টি শোষণে সমস্যা হয়। এই আগাছা নিয়ন্ত্রণে কৃষকরা ব্যবহার করেন ঘাস মারা বিষ। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে “রাউন্ডআপ”, “টাচডাউন”, “গ্রামক্সোন”, “গ্লাইফোসেট” প্রভৃতি নামে রাসায়নিকগুলো পাওয়া যায়। এগুলোর কার্যকর উপাদান সাধারণত গ্লাইফোসেট বা প্যারাকুয়াট। স্প্রে করার কয়েক দিনের মধ্যেই আগাছা মরে যায়, ফলে জমি প্রস্তুত বা ফসল রোপণে সময় কম লাগে। আগে কৃষকদের ৫-৭ জন শ্রমিক লাগত আগাছা পরিষ্কারে। এখন এক লিটার ঘাস মারা বিষ দিয়েই এক বিঘা জমি পরিস্কার করা যায়। এতে খরচ অর্ধেকে নেমে আসে, সময়ও বাঁচে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে বৃষ্টির আগেই জমি প্রস্তুত করতে এই বিষের ব্যবহার কৃষকদের কাছে আশীর্বাদ মনে হয়।
তবে এর ক্ষতিকর প্রভাবও ভয়াবহ। অতিরিক্ত বা ভুল মাত্রায় স্প্রে করলে মাটির জীবাণু মারা যায়, যা মাটির উর্বরতা কমায়। বিষাক্ত উপাদান বৃষ্টির সঙ্গে নদী-খালে গিয়ে মাছসহ জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়। গ্লাইফোসেট জাতীয় উপাদান মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ায়Íবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) গবেষণায় এমন তথ্যও রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় দেখা যায়, কৃষকেরা হাত-পা ঢেকে না রেখে খালি গায়ে বা খালি হাতে বিষ স্প্রে করছেন। কেউ কেউ এমনকি বাতাসের দিক না দেখে স্প্রে করেন, ফলে নিজের শরীরেই বিষ লাগে। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে মাথা ব্যথা, বমি বা ত্বকে জ্বালাপোড়ার উপসর্গ দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণভাবে ঘাস মারা বিষ বন্ধ না করে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আগাছা দমনে জৈব বা পরিবেশবান্ধব উপকরণ যেমনÍজৈব সার, মালচিং ও ফসল চক্র ব্যবস্থার প্রচলন বাড়ানো যেতে পারে। কৃষি অফিসারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মশালা কৃষকদের সঠিক ব্যবহারে সাহায্য করবে।
ঘাস মারা বিষ নিঃসন্দেহে আধুনিক কৃষিতে সময় ও শ্রম বাঁচানোর এক কার্যকর উপায়। তবে অন্ধভাবে ব্যবহারে তা জমি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। সুতরাং প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কৃষক প্রশিক্ষণ ও সরকারি নজরদারি। নইলে “ঘাস মারা বিষ” একদিন ফসল নয়, ভবিষ্যৎকেই মেরে ফেলবে।