বিপুল জনবল সংকট চলছে। আছে নানা সমস্যা। তবুও থেমে নেই বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ফসল ফলানোর লড়াই। আর এই লড়াই দেশের উত্তরাঞ্চলকে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ‘উদ্বৃত্ত’ অঞ্চলে পরিণত করেছে বলে জানা গেছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা বলছেন, বিএমডিএ উত্তরাঞ্চলের জন্য আশির্বাদ। দেশের শস্যভাণ্ডারে পরিণত হওয়ার পিছনে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিআইএডিপি) থেকে জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালু করা হয়। ১৯৯২ সালে নতুন নামকরণ করা হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- বিএমডিএ। ২০১৮ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ পাশ হয় সংসদে। গভীর নলকূপ স্থাপন, নিবিড় বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ, সেচনালা নির্মাণ, খাল খনন ও গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে বর্তমান রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলা মিলে ১৩৫টি উপজেলা এলাকায় বিএমডিএ’র কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই সংস্থার নানা কর্মসূচিতে দেশের উত্তরাঞ্চল খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ঘটেছে বিপুল পরিমাণ গাছগাছালির সবুজ সমারোহ।
এই বিপুল কর্মতৎপরতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কৃষি-প্রকৌশলবিদ ও জলাশয় বিশেষজ্ঞ ড. মো. আসাদউজ্জামান। তাঁর হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তবে বিগত প্রায় দেড় দশক যাবত এই কার্যক্রম ছিল দুর্নীতি ও অব্যবস্থার শিকার। এবার সরকার পরিবর্তনের পর অবসরে থাকা ড. আসাদউজ্জামানকে সংস্থার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। এই সঙ্গে বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক (ইডি) হিসেবে নিয়োগ পান অতিরিক্ত সচিব মো. তরিকুল আলম। কিন্তু কিছুদিন আগে আকস্মিকভাবে ইন্তিকাল করেন চেয়ারম্যান ড. আসাদউজ্জামান। সরকার পরিবর্তনজনিত কারণে কিছু দিন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে চলে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিএমডিএ-এর নয়া নির্বাহী পরিচালক (ইডি) নিয়োগ ও তার নেতৃত্বে পরিস্থিতি স্থিতি ফিরে পায়। যদিও ড. আসাদউজ্জামানের মৃত্যুতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদটি এখনো শূন্য রয়েছে।
বিপুল কর্মতৎপরতা: বিএমডিএ-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এক বিপুল কর্মতৎপরতা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গভীর নলকূপ পুনর্বাসন করা হয়েছে ৪৫০টি, ভূ-গর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩০৫ কিলোমিটার, ভূ-গর্ভস্থ পাইপলাইন বর্ধিতকরণ করা হয়েছে ২০০ কিলোমিটার, ফিতাপাইপ সংগ্রহ হয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ মিটার, খাস খাল ও খাড়ি পুনঃখনন করা হয়েছে ১২২ কিলোমিটার। খাস পুকুর পুনঃখনন হয়েছে ৫৬টি, বিল পুনঃখনন একটি, ক্রসড্যাম নির্মাণ ২২টি, নদীতে পন্টুন স্থাপন ২টি, সেচযন্ত্রে (এলএলপি) সোলার সিস্টেম স্থাপন ৫৬টি, নদী, খাল ও পুকুর পাড়ে এলএলপি স্থাপন ৮৯টি, ফুটওভার ব্রিজ ৬টি, বীজ উৎপাদন ৫০০ মেট্রিক টন, ৫৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এযাবত সম্পন্ন কাজ: প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে খাস খাল/খাড়ি পুনঃখনন করেছে ২ হাজার ৬৪৯ কিলোমিটার। খাস পুকুর পুনঃখনন ৪ হাজার ৩১৩টি, বিল পুনঃখনন ৮টি, ক্রসড্যাম নির্মাণ ৮০০টি, নদীতে পন্টুন স্থাপন ১৩টি, সেচযন্ত্রে (এলএলপি) সোলার সিস্টেম স্থাপন ৬৭৬ টি,নদী,খাল ও পুকুর পাড়ে এলএলপি স্থাপন মোট ১০৫৫টি, গভীর নলকূপ পুনর্বাসন ৪ হাজার ৭৯০ টি, ভূ-গর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ ১৫ হাজার ৩৪৮ কিলোমিটার, ভূ-গর্ভস্থ পাইপলাইন বর্ধিতকরণ নির্মাণ ২ হাজার ৫২ কিলোমিটার, ফিতাপাইপ সংগ্রহ ৭ লাখ ২৯ হাজার ৬০০ মিটার, ফুটওভার ব্রিজ ৫২ টি, বীজ উৎপাদন ৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩০২ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়াও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ করা হয়েছে ১৩ হাজার হেক্টর জমির। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জুন ২০২৫-এ মোট ১৫ হাজার ৫৬০টি গভীর নলকূপ ও ৯৯১টি এলএলপি (সর্বমোট ১৬,৫৫১টি সেচযন্ত্র) ব্যবহার করে প্রায় ৬ লক্ষ ২৮ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৭০ লক্ষ ৫৯ হাজার ৯৮৪ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে এবং উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৬ জন।
জনবল সংকট: জানা গেছে, এতো বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান চলছে মাত্র ১২৫ জন কর্মকর্তার নেতৃত্বে। এর মধ্যে চলতি দায়িত্বে কাজ করছেন ৯৫ জন। জনবল কাঠামো না থাকায় পদায়ন ও পদোন্নতিসহ বেতনভাতা নির্ধারণে চরম বৈষম্যের অভিযোগ করেছেন বিএমডিএ-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মানবসম্পদ অব্যবস্থাপনায় বিএমডিএতে প্রায় দুই যুগ ধরে চলেছে বিশৃঙ্খলা। তারা সুষম জনবল কাঠামো অনুমোদনের দাবি করেন। প্রতিষ্ঠার পর ২০০৩ ও ২০০৮ সালের পর আর কোনো জনবল নিয়োগ হয়নি। অতীতে ১ হাজার ২৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ৭০৩ জন। বাকি জনবলের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে অস্থায়ী ও আউট সোর্সিং থেকে। বর্তমানে কর্তৃপক্ষের কাজ আরো বেগবান ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য ১ হাজার ৯১১ জন জনবলের সমন্বয়ে একটি প্রস্তাবিত জনবল কাঠামো মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা আছে। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চ.দা) (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মো: শামসুল হোদা বলেন, “জনবল কাঠামোর বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিবে বলে আশা করছি।” নির্বাহী পরিচালক (ইডি), মো: তরিকুল আলম বলেন, “৬০০ জনের একটি আদেশ মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষমাণ রয়েছে। আগে এই আদেশটি আসার কথা। পরে ১ হাজার ৯১১ জন জনবলের সমন্বয় সমাধান হওয়ার কথা।” তিনি আরো বলেন, “বিভিন্ন অভিযোগসূত্রে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি করা হয়েছে। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী আরো কিছু বদলির নির্দেশ দেয়া হবে। রাজপাড়া থানায় একটি মামলা রয়েছে, এটি তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।