সারা দেশে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। কোথাও আবার মাঠেই দোল খাচ্ছে সোনালী শীষ। ধান কাটার মেশিনের জোগান চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বেশি মজুরি দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে কৃষকদের। উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে তারা। ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে একটা শংকা ভর করছে কৃষকের মনে। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ে কী মূল্য বেঁধে দেয়া হয়, সবার দৃষ্টি সে দিকে। এ সংক্রান্ত আমাদের সাংবাদদাতাদের পাঠানো খবর
আত্রাই (নওগাঁ) : উপজেলার মাঠে মাঠে দুলছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। বোরো ধানের সবুজ আভা কেটে হলুদাভ হতে শুরু করেছে। কোথাও পাকতে শুরু করেছে বোরো ধান।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে, এবার উপজেলার ৮ ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। ধান নির্ভরশীল এলাকা হিসেবে আত্রাইয়ের প্রধান আবাদই বোরো ধান। বিশেষ করে উপজেলার মানিয়ারী, বিশা, ভোঁপাড়া, শাহাগোলা ও পাঁচুপুর ইউনিয়ন বোরো ধানের জন্য খ্যাত। এছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়েনে বোরো ধানের চাষ হয়ে থাকে। এবারে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। ধান রোপনের শুরু থেকেই অনুকূল আবহাওয়া ও সঠিক পরিচর্যায় এবারের বোরো ধান মাঠে মাঠে দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু এলাকায় আগাম জাতের ধান পাকতেও শুরু করেছে। অধিকাংশ এলাকার মাঠ জুড়ে সোনালী রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে বোরো ধানের শীষ। আর এ সোনালী শীষে দোল খাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন।
উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের কৃষক আজাদ প্রামানিক, শাহাগোলা গ্রামের আজাদ সরদার, বজ্রপুর গ্রামের মজিদ মন্ডল বলেন, মুলত আমাদের এলাকার প্রধান আবাদই হলো বোরো ধান। বোরো ধানের মধ্যে আমরা জিরাসাইল ধানের আবাদ সর্বাধিক পরিমাণ জমিতে করে থাকি। কিছু কিছু জমিতে নতুন অন্য জাতের ধানের চাষও করা হয়েছে।
শুরু থেকেই আবহাওয়া ভাল থাকায় ধানের শীষগুলো দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ না হলে এবারে বাম্পার ফলন হবে বলে আমরা আশাবাদি।
কৃষকরা আরও বলেন, উপজেলার বিভিন্ন মাঠে আগাম রোপণকৃত ধান ৮-১০ দিনের মধ্যে কাটামাড়াই শুরু হবে। কাটামাড়াই পুরোদমে শুরু হতে আরও এক সপ্তাহ লাগতে পারে। এ সময় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে তারা বলেন, ঝড়ো আবহাওয়া ও শিলাবৃষ্টির শঙ্কা মাথায় নিয়ে কৃষকরা মাঠে রয়েছেন। স্বপ্নের ধান কেটে ঘরে তুলতে পারলে এ ফসলে বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা।
এ ব্যাপারে উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান ও মারজিয়া পারভিন বলেন, বিশেষ করে অধিক ফলেন জন্য পরিমিত সার ব্যবহার, পানি সাশ্রয় এবং সার্বিক পরিচর্যায় কৃষকদের সচেষ্ট হতে আমরা সব সময়ই পরামর্শ দিয়ে আসছি। এবার আত্রাই উপজেলার কোথাও মাঝড়া পোকার আক্রমণ নেই। এবং উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
শ্যামনগর : উপকূল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় এবার বোরো ধানের ফসল ভাল হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। বোরো চাষিদের দাবী ধানের ন্যায্য মূল্য পেলেই তারা খুব খুশি। ধান উৎপাদনের অনুকুল পরিবেশ থাকায় বোরোর ফসল ভাল হওয়ার কারণ বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। লবনাক্ত এলাকা শ্যামনগরে মিষ্টি পানির প্রাপ্যতা বেশি হলে বোরো আবাদ আরও বেশি হত বলে উপজেলা কৃষি অফিস মত প্রকাশ করেন।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে প্রকাশ উপজেলায় চলতি বছরে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ২৭১৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রিড আবাদ ৯১৫ হেক্টর ও উফসি আবাদ ১৮০০ হেক্টর। গতবারে আবাদ হয় ২৩১০ হেক্টর। গতবার হাইব্রিড আবাদ ছিল ৮১০ হেক্টর ও উফসি ১৫০০ হেক্টর। জানা যায় প্রতিবছর বোরো ধানের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
বোরো ধানের ফলন হয়েছে হাইব্রিড চাউলে প্রতি হেক্টরে ৪.৮ মেট্রিকটন ও ধানে ৭.২ মেট্রিকটন। উফসি ফলন হয়েছে চাউলে ৪.০ মেট্রিকটন ও ধানে ৬.০ মেট্রিকটন। বিঘাপ্রতি মণে ধান হয়েছে হাইব্রিড ২৪ মণ ও উফসি ২০ মণ। শ্যামনগর উপজেলার আবাদকৃত বোরো ধানের জাত ছিল হাইব্রিড এসএল-৮, মদিনা-১, ছক্কা, তেজগ্লোড ও ৭৭৭।
উফসি জাত ছিল ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-৬৭, ব্রিধান-৭৪, ব্রিধান-৮৯, ব্রিধান-১০০, বিনাধান-১০ ও বিনাধান-২৪।
এবার বোরো আবাদ বেশি হয়েছে শ্যামনগর ইউপিতে ও কম হয়েছে গাবুরা ইউপিতে। ইউনিয়ন অনুযায়ী ১২টি ইউপিতে বোরো আবাদের পরিমাণ হল ভূরুলিয়ায় ১৯৬ হেক্টর, কাশিমাড়ী ৩২৯ হেক্টর, শ্যামনগর ৩৫৯ হেক্টর, নুরনগর ১৭২ হেক্টর, কৈখালী ৩২৭ হেক্টর, রমজাননগর ১৩৮ হেক্টর, মুন্সিগঞ্জ ২১৯ হেক্টর, ঈশ^ীরপুর ২০৪ হেক্টর, বুড়িগোয়ালিনী ১৯৮ হেক্টর, আটুলিয়া ২৮৫ হেক্টর, পদ্মপুকুর ২৩৪ হেক্টর ও গাবুরা ৫৪ হেক্টর।
শ্যামনগর উপজেলার ভূরুলিয়া ইউপির বোরো চাষি লিয়াকত আলী বলেন দুই বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন। তিনি ফসল পেয়েছেন বিঘা প্রতি ২২ মণ। গতবারও তিনি বোরো ধান চাষ করেছিলেন এবার গতবারের তুলনায় ভাল ফলন পেয়েছেন বলে জানান। তবে তিনি অভিযোগ করে বলেন ইঁদুরের উপদ্রব কম থাকলে আরও বেশি ফলন পাওয়া যেতে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার নাজমুল হুদা বলেন সঠিক সময়ে সেচ সুবিধা, সার বিতরণ, কৃষি অফিসের পরামর্শ সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থাকায় বোরো ধানের ফলন বেশি পেয়েছেন বোরো চাষিরা।
শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকার বোরো চাষিরা জানান উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে খালগুলিতে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে বোরো আবাদ সহ অন্যান্য ফসলের আবাদ আরও বৃদ্ধি পাবে। কৃষি ফসলের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে। কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায় বর্তমানে পুনঃ খনন যোগ্য খালের সংখ্যা ৪৩টি। উপজেলায় খাল রয়েছে ১২০টির অধিক। উপজেলার কৃষককুলের দাবি ফসল ভাল এবার দাম ভাল পেলে আমরা খুশি।
ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) : দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায় এবার ইরিবোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। অনেক কৃষক ইতোমধ্যে ধান ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম এবং ধানে তেমন কোনো রোগবালাই কম থাকায় ফলন অত্যন্ত ভালো হচ্ছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি শুরু হবে ধান কাটার কাজ।
ফুলবাড়ী উপজেলা ০৭টি ইউনিয়ন ও ০১টি পৌরসভায় এবং সীমান্ত এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, সবুজ ধান পেকে সোনালি রঙ ধারণ করেছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনালি ধানের শীষ। এ দৃশ্য দেখে কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি।
দুই সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হবে ধান কাটা। ফুলবাড়ীর কাজিহাল ইউপির কৃষক মোঃ নুর ইসলাম এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমরা পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও বছরে দুবার ধান চাষ করে থাকি। ধানের পাশাপাশি এর বিচালি উৎকৃষ্ট মানের গো-খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
শিবনগর ইউপির কৃষক মোঃ আব্দুল হামিদ বলেন, আমি এবার দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। ধান খুব ভালো হয়েছে। আগামী এক/দুই সপ্তহ পর ধান কাটা শুরু করবো। নিজের খোরাকের জন্য কিছু রেখে বাকি বিক্রি করবো। মাঠের ধান দেখে খুব আশাবাদী। তবে কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টির আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় আছি। ধান ঘরে না উঠা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না।
ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ শাহিনুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে ফুলবাড়ী উপজেলায় উৎপান লক্ষ্যমাত্রা ৯২ হাজার ১৩৮ হেক্টর। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬১ হাজার মেট্রিটন। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব তেমন ছিল না এবং ধানে রোগবালাইও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ঝড় ও শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাসের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কৃষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এখন প্রায় শতাংশ ধান পেকে গেলে দ্রুত ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফুলবাড়ীতে গত বছরের চেয়ে এ বছর বোর ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
মুরাদনগর (কুমিল্লা) : কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় কৃষকের ব্যস্ত সময় কাটছে। সোনালি ধানে ভরে গেছে মাঠগুলো। মুরাদনগর উপজেলায় ১৭০ হাজার ৭২ হেক্টর জমি আবাদ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে।
কৃষকরা জানান, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সময়মতো চাষাবাদ হওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বিলের পরিশ্রমী কৃষকরা ভোর থেকে শুরু করে দিনভর ব্যস্ত থাকছেন ধান কাটা, মাড়াই ও ঘরে তোলার কাজে।
মুরাদনগর উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের কৃষক নাঈম ভূইয়া বলেন, এই বিলে ওপরই আমাদের জীবন। আল্লাহর রহমতে এবার ফলন ভালো। ধানও ভালো দাম পাইলে আশা করি খরচ মিটাইতে পারব। সরকার সহায়তা, যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতিতে, আরও সহজ হয়েছে। এ বিলের ওপর নির্ভর করে হাজার হাজার কৃষক পরিবারের জীবিকা। প্রতি বছর বোরো ধান কাটা শুরু হলে এখানে তৈরি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশ, যেখানে কৃষিকাজের পাশাপাশি দেখা যায় পারস্পরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য চিত্র। এবার কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কিছু এলাকায় আধুনিক ধান কাটা মেশিনের ব্যবহারে কাজ দ্রুততর হচ্ছে। হাওরের ধান কাটা সফলভাবে শেষ হলে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠজুড়ে চলছে হাজারো কৃষকের ব্যস্ততা। কেউ কাটছেন ধান, কেউ মাড়াই করছেন, কেউ-বা ট্রলিতে করে ঘরে তুলছেন সোনালি ফসল। সব মিলিয়ে হাওরের প্রতিটি কোণে যেন গেয়ে উঠছে সোনালি ধানের গান।
মুরাদনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খাঁন পাপ্পু জানান, মুরাদনগর উপজেলায় এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ১৭০৭২ বোরো আবাদ এর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭০৮৭ হে। আজ পর্যন্ত ধান কর্তন হয়েছে ৭১৭০ হেঃ যা মোট আবাদের ৪১%। বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০৬১১০ মেঃটন (ধানে)। মুরাদনগর উপজেলায় এখন পর্যন্ত ৩৭ টি কম্বাই হারভেস্টর বিভিন্ন ইউনিয়নে ধান কর্তন করছে। মুরাদনগর উপজেলার ১৪টি কম্বাইন হারভেস্টর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কর্তন করার জন্য কম্বাইন হারভেস্টর মুরাদনগরে এসেছে।