আর্থিকভাবে রুগ্ন হয়ে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ নামে ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গত মাসে অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে নতুন ব্যাংকের সংঘবিধি ও সংঘস্মারক ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স ও কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধনের জন্যও নেয়া হয়েছে উদ্যোগ। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই যাতে নতুন ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয় সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের প্রথম কাজ হবে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করা। আমানত ফিরে পাবার নিশ্চয়তা দেয়া। এটি যদি করা না যায়, তাহলে একীভূত করেও কোনো লাভ হবে না।

৫টি ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে পুরো ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনিস্টিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্টস অব বাংলাদেশ আইসিএবির ফেলো সদস্য মোহাম্মদ লিটন মিয়া বলেন, প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের আরও কাছে পৌঁছাতে হবে। আস্থা অর্জন করতে হবে। বর্তমানে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। গ্রাহকদের মাঝে ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাহকদের বিশ্বাস করাতে হবে যে, ব্যাংকে টাকার কোনো সংকট নেই। এজন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। তবেই তাদের মাঝে আস্থা ফিরে আসবে। ব্যাংকগুলোর উপর গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসলে, আশাকরা যায় এই অস্থিরতা কেটে যাবে। তিনি বলেন, এখন ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। আস্থা ফেরত না আসা পর্যন্ত তারা ব্যাংকে টাকা রাখবে না। আর ব্যাংকে টাকা না রেখে যদি ঘরে টাকা রাখে তবে খরচের পরিমাণ বড়ে যাবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে তাদেরকে ব্যাংকমুখী করাতেই হবে। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ।

সূত্র মতে, একীভূত হতে যাওয়া এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল, সোশ্যাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকে বর্তমানে কর্মীর সংখ্যা ১৮ হাজারেরও বেশি। প্রতি বছর তাদের বেতন-ভাতার পেছনে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। সেই সঙ্গে পরিচালন ব্যয়ের জন্য ব্যয় হয় বড় অংকের অর্থ। এ অবস্থায় নতুন ব্যাংকটি বিশাল কর্মীর চাপ বহন করে টেকসই হতে পারবে কিনা সে শঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাঁচ ব্যাংকের কর্মীরা বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু একীভূতকরণের পর তারা সরকারি ব্যাংকের অংশ হয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে তাদের চাকরির মর্যাদা ও সুবিধাদি অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের কর্মীদের মতোই হবে কিনা, সেটি এখনো নির্ধারিত হয়নি। তাছাড়া সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাংকটিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার কথা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কর্মীদের বর্তমানে সরকারি ব্যাংকের কর্মীর মর্যাদা দেয়া হলে পরবর্তী সময়ে এটি বেসরকারি ব্যাংক হয়ে যাওয়ার পর তাদের মর্যাদা কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ বিষয়গুলোয় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, নতুন ব্যাংক গঠনের পর শুধু যে অর্থ ব্যয় হবে তা নয়, সরকারি ব্যাংক হওয়ার কারণে এখানে মানুষ আমানত রাখতে আগ্রহী হবে। সেই সঙ্গে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকের আয় আসবে।

জানা গেছে, নতুন ব্যাংক গঠনে প্রয়োজনীয় নথিপত্র তৈরি থেকে শুরু করে আইনি যেসব আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরই মধ্যে বিভাগটির পক্ষ থেকে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি নামে নতুন ব্যাংকের সংঘবিধি ও সংঘস্মারক তৈরি করে সেটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ভেটিং হয়ে আসার পর নতুন ব্যাংকের নামের ছাড়পত্র ও কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) কাছে আবেদন করা হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্যও আবেদন করা হবে। সবকিছু অনুমোদন পাওয়ার পর ব্যাংকটিতে মূলধন সরবরাহ শুরু করবে সরকার। পরিকল্পনা অনুসারে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার, যার ১০ হাজার কোটি টাকা নগদে এবং বাকি ১০ হাজার কোটি সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে নতুন ব্যাংকের শেয়ার ইস্যু করা হবে, যা বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের গ্রাহক ও অন্যান্য পাওনাদারের পাওনার একাংশ শেয়ারে রূপান্তর হবে। পরে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি পরিশোধ করা হবে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ব্যাংক, পর্ষদ গঠন ও এর পরিচালনার বিষয়টি তারা দেখভাল করছেন। একীভূত হওয়ার পর পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকের সমুদয় সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকের অধীনে চলে যাবে এবং এটি একটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হবে। নতুন ব্যাংক গঠনের পর পাঁচ ব্যাংকের যেসব ক্ষুদ্র আমানতকারী রয়েছেন তাদের অর্থ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। আর বড় আমানতকারীদের অর্থ ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হবে।

নতুন ব্যাংক গঠনের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, আমরা নতুন ব্যাংক গঠনের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি। অনেক অগ্রগতিও হয়েছে। আমরা গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের বিষয়টাকে বেশি প্রাধাণ্য দি্িচছ।

একীভূতকরণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, সরকার তার দিকের কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের কাজগুলো গুছিয়ে এনেছে। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই একীভূত ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে ২০২৪ সাল শেষে এক্সিম ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৬২৭ কোটি এবং আমানত রয়েছে ৪২ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৯০৩ কোটি এবং সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ একই সময় শেষে ৬৯ হাজার ২১৭ কোটি এবং আমানত ৪৩ হাজার ১৪১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৫৫ হাজার ৯২০ কোটি এবং সঞ্চিতি ঘাটতি ৪৭ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ পরিমাণ ১৯ হাজার ২২০ কোটি এবং আমানত রয়েছে ১৩ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৮৮ কোটি ও সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ৮ হাজার ৮৮১ কোটি টাকার। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ ৪৭ হাজার ৭১৭ কোটি এবং আমানত ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার ৬৩৩ কোটি ও সঞ্চিতি ঘাটতি আছে ২১ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক গত বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৩১৫ কোটি এবং আমানত ছিল ২২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা।

পাঁচ ব্যাংকের শাখার সংখ্যা বর্তমানে ৭৬১টি। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১৫৫, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখা ২০৬, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে শাখা ১০৫, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শাখা ১৮১ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের শাখা ১১৪টি।

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, আমাদের ব্যাংকিং খাত আজ এক নতুন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি দেশের পাঁচটি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়ে বাজারে জোরালো আলোচনা চলছে। কেউ একে ‘খাত পুনর্গঠনের প্রয়াস’ হিসেবে দেখছেন, অনেকে আবার বলছেন এটি ‘জোরপূর্বক একীকরণ’। প্রশ্ন হলো, এই মার্জার কি সত্যিই ইসলামি ব্যাংকিং খাতকে টেকসই করবে, নাকি এটি হবে ব্যাংকিং খাতে আস্থার একটি নতুন সংকটের সূচনা, সেটি সময়ই বলে দিবে।

কলাম লেখক ও সংগঠক মাহবুবুর রহমান সুজন বলেন, ব্যাংক মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। এখন গ্রাহক-ব্যাংকারের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক ও বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে। কেউ নিজ আমানত তুলতে না পেরে গালিগালাজ, কেউবা কান্নাকাটি করছেন। গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব গ্রাহকদের সংশয় কাটিয়ে ব্যাংক যে প্রকৃত আস্থা, নিরাপদ ও বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান তা নিশ্চিত করা।