নানান সংকট ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ছে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার। গত বছরের ডিসেম্বের মাসের তুলনায় এ বছর জানুয়ারি-মার্চে ডিপোজিট বা আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৩২ মিলিয়ন টাকা। এসময় ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি ও রফতানি এবং রেমিটেন্স বাবদ আয়ও বেশ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৮টি ব্যাংক ‘পূর্ণাঙ্গরূপে শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং’ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হলো, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক (এক্সিম), আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আরো কিছু ব্যাংক সাধারণ ব্যাংকিং-এর পাশাপাশি ইসলামিক উইন্ডো পরিচালনা করছে। সবমিলিয়ে ইসলামিক ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে পরিচালিত লেনদেন ও ব্যবসার বিষয়ে পৃথক প্রতিবেদন দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক মুনাফা ভাগাভাগির ভিত্তিতে বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট (মুদারাবাহ) ও অর্থায়ন সুবিধা (মুশারাকাহ) চালু করে। ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইসলামী ব্যাংকের সাফল্যের ফলে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গড়ে উঠে।
আমানত বৃদ্ধি : বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ২৯ হাজার ৬২০ মিলিয়ন টাকা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে এর পরিমাণ ছিল ৪৩ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮০ মিলিয়ন টাকা। বৃদ্ধির পরিমাণ ৩২ হাজার ৪০ মিলিয়ন টাকা। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধির হার দশমিক ৭৩ শতাংশ। প্রতিবেদনের অধীনে থাকা সময়কালে সমগ্র ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছিল ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের অংশ।
মোট বিনিয়োগ : এবছর ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মোট বিনিয়োগ (ঋণ ও অগ্রিম) ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের তুলনায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ মিলিয়ন টাকা বেশি। যা ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ লাখ ২৪ হাজার ৭২০ মিলিয়ন টাকায় পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে সমগ্র ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ ও অগ্রিমের ২৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছিল ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ।
তারল্য পরিস্থিতি: ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যও হ্রাস পেয়েছে। এবছর ৩২ হাজার ২৯০ মিলিয়ন টাকা কমে সেটি ৬২ হাজার ৬০ মিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের তারল্য ছিল ৯৪ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন টাকা।
রপ্তানি আয় : চলতি বছর জানুয়ারি-মার্চ মাসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট রফতানি আয় ছিল ৪৫ হাজার ৪১০ মিলিয়ন টাকা। এটি ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ৬৯ হাজার মিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে যা ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ৫৯০ মিলিয়ন টাকা।
আমদানি আয় : এবছর জানুয়ারি-মার্চে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মোট আমদানি পরিশোধ ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ১১০ মিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৩০ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন টাকা বা ৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্স আয় : এ বছর একই সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স ২ লাখ ২৭ হাজার ৬১০ মিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২১ দশমিক ০৫ শতাংশ বেশি।
শাখার সংখ্যা : ২০২৫ সালের মার্চ শেষে প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইসলামী শাখাসহ ইসলামী ব্যাংকগুলোর শাখার সংখ্যা ১ হাজার ৭৩৬-এ উন্নীত হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এটি ছিল ১ হাজার ৭৩১টি এবং ২০২৪ সালের মার্চ শেষে এটি ছিল ১ হাজার ৭০৩টি। একই সময়ে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডোর সংখ্যা ৮৩০-এ উন্নীত হয়, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ছিল ৮২৫টি। ২০২৪ সালের মার্চ মাসের শেষে এটি ছিল ৬৪৬টি।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে মোট কর্মসংস্থানের সংখ্যা ছিল ৫২,২৩১টি। পূর্ববর্তী প্রান্তিকের শেষে এটি ছিল ৫২ হাজার ৫৬৫ এবং পূর্ববর্তী বছরের একই প্রান্তিকে এটি ছিল ৫১ হাজার ২৭২টি।
সংকটকাল অতিক্রম : ২০২৪ সালের পূর্ববর্তী তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের হিসাবে দেশের মোট ব্যাংকিং খাতের সম্পদের ২৫ শতাংশেরও বেশি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার অধীনে আছে। প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি ও সম্ভাবনা সত্ত্বেও ঋণ অনিয়ম, কেলেঙ্কারি ও শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতির কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে এ খাত বড় ধরনের সংকটে পড়ে। ২০২২ সালের শেষের দিকে শরিয়াহভিত্তিক এক ডজন ব্যাংকের সম্পদের মানের অবনতি ও বেশ কয়েকটি ঋণ অনিয়ম প্রকাশ্যে আসায় ইসলামী ব্যাংকিং খাত প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। এটি এই খাতের প্রবৃদ্ধি ও তারল্য সূচকে প্রভাব ফেলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুসারে, ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি এর আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসে। এক বছর আগে তা ছিল ২০ দশমিক ১ শতাংশ। এখন এই হিসাবের সবগুলো সূচকেই প্রবৃদ্ধি ঘটছে বলে জানা গেছে।