ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করা হবে। নতুন ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। নতুন ব্যাংকের নামে লাইসেন্স ইস্যু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন সেটির অধীনে চলে যাবে পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায়। এরপর সেগুলোতে প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রশাসকেরা একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবেন। এর মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংক মিলে ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক গড়ে উঠবে। সরকার ৫ দুর্বল ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নতুন ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও এতে গ্রাহকদের দুশ্চিন্তা কাটছে না। ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকার যদি শক্ত হাতে এই ব্যাংক পরিচালনা করতে না পারে তখন গ্রাহকরা আরো সঙ্কটে পড়তে পারে। তারা বলছেন, চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। খুব সামান্য টাকাও অনেক সময় দিতে পারে না। আবার বুথ থেকেও এক-দুই হাজারের বেশি টাকা তোলা যায় না।

সূত্র মতে, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগিতায় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শরিয়াহভিত্তিক এই পাঁচটি ব্যাংক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ব্যাংকগুলোর ঋণের বেশিভাগই এখন খেলাপি হয়ে আছে। ফলে ওই ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই পাঁচটি ব্যাংক ৪৮ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ এখন খেলাপি রয়েছে। যে কারণে তারা গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। যে কারণে গ্রাহকদের নানা অসন্তুষ্টির মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একীভূত করার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংক একীভূত করতে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এখন প্রশাসকেরা এই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নেবেন। আগের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা দল বহাল থাকলেও পর্ষদ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। একীভূত করার প্রক্রিয়া শেষ হলে ব্যাংকগুলোর বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল হয়ে যাবে। প্রশাসকেরা শুরুতে ব্যাংকগুলোর যে সম্পদ রয়েছে, তা পুনর্মূল্যায়ন করবেন। পাশাপাশি প্রযুক্তির মাধ্যমে সব ব্যাংকের সম্পদ ও দায় এক করে ফেলার উদ্যোগ নেবেন। জনবল পর্যালোচনা করে ব্যাংকগুলোর মানবসম্পদ বিভাগ একীভূত করা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজন ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ারে রূপান্তরিত করা হবে। বাকি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা এসব ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ১০ শতাংশ শেয়ারে রূপান্তরের পরিকল্পনা করেছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত ধারাবাহিকভাবে কমে গত মে মাসে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায় নেমেছে, যা গত মার্চে ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আমানত কমার বিপরীত চিত্র রয়েছে ঋণে। সুদসহ নিয়মিতভাবে ঋণের স্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। গত মে মাসে এসব ব্যাংকের ঋণস্থিতি কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, যা গত মার্চে ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। শতাংশ বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। এই হার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ শতাংশ ও এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ শতাংশ।

এদিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার হিসেবে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৫০ কোটি, এসআইবিএল ৬ হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ২ হাজার ২৯৫ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিই গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বারবার ওই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়ার পরও ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর ব্যাংকগুলোর বোর্ড সব ভেঙে যাবে। নতুন ব্যাংকের নতুন বোর্ড হবে। নতুন ব্যাংকের বোর্ডে কে কে থাকবে সেটি পরে ঠিক করা হবে। গভর্নর বলেন, আমি গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দেখলাম এই ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট ব্যাপক। তারা গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। আমরা এরই মধ্যে তাদেরকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই পাঁচটি ব্যাংককে এক করব। ভালোভাবে রি-ক্যাপিটালাইজ করব। প্রথমে এটা সরকারি ব্যাংক হিসেবে হবে, পরবর্তীতে এটাকে আমরা প্রাইভেটাইজ (বেসরকারি খাত) করে দেবো। তবে এই কাজটি একেবারে সহজ নয় এবং এ জন্য যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে আছে সেটিও বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

ব্যাংক একীভূত হলে সেই সঙ্কট কাটবে বলে এমন আশা করছেন ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা। তবে গ্রাহকদের কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কার কথা বলছিলেন কেউ কেউ। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে এক করলে সেটি আরো বড় একটি দুর্বল ব্যাংকই হবে। তাতে সঙ্কট কতটুকু কাটবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে অর্থনীতিবিদদের।

জানা গেছে, একীভূত ব্যাংকের সব সম্পদ ও দায়ভার স্থানান্তরিত হবে নতুন গঠিত ব্যাংকের অধীনে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণখেলাপিসহ নানা কারণে বিশ্বে এমন ব্যাংক একীভূত করার নজির থাকলেও বাংলাদেশে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি।

এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, প্রথমত মার্জ করা ব্যাংকটি দু’বছরের জন্য সরকারি খাতে থাকবে। পরবর্তীতে এটা বেসরকারি খাতে যেতে পারে।

বিগত সরকারের আমল থেকেই বাংলাদেশের এই ব্যাংকগুলো নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে নানা অসন্তোষ ছিল। অনেকেই ব্যাংকগুলোতে গিয়ে টাকা তুলতে গিয়ে না পেয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। ওই ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি ব্যাংকের গ্রাহক ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, আমার টাকা, ব্যাংকে জমা কিন্তু টাকা তুলতে যাই, ব্যাংক থেকে বলে পরে আসতে। এই ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। আমাদের এই ভোগান্তি কবে দূর হবে জানি না।

ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখনই এটি বলার সুযোগ নেই যে সরকারি উদ্যোগে একীভূত হওয়ার পরই গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পাবে কিংবা এই ব্যাংকগুলোতে থাকা সঙ্কট কেটে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেছেন, ক্ষমতাশালী গ্রাহকদের অনেকে এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেলছে। সাধারণ গ্রাহকরা হা হুতাশ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সফল মার্জার না হলে তা গোটা ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থার ঘাটতি তৈরি হবে। সরকার হয়তো এটা আস্থা বাড়ানোর জন্য একীভুত করছে। কিন্তু এটা করার কথা শোনার পর গ্রাহকদের অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেলার জন্য লাইন ধরছে। তাহলে কী সঙ্কট বাড়ল নাকি কমল?

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক গ্রাহক বলেন, আমার এক লাখ টাকার চেক দুই মাস ধরে হাতে নিয়ে ঘুরছি, টাকা দিতে পারেনি শাখা। অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক বলছেন, আমার জরুরি চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার, কয়েকবার শাখায় গিয়েও টাকা তুলতে পারিনি। একবার মাত্র ১০ হাজার টাকা দেওয়ার অনুমতি দিলো, এত কম টাকায় তো চিকিৎসা হয় না। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি খুব চাপের। প্রতিদিন গ্রাহকেরা এসে বকাঝকা করছেন। টাকা নেই, দেব কীভাবে? মার্জার হলে সরকার যদি তারল্য সহায়তা করে, তাহলে গ্রাহকদের টাকা দিতে পারব।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একীভূত ব্যাংকে ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫০০টি এজেন্ট আউটলেট এবং ১,০০০টির বেশি এটিএম বুথ নিয়ে গড়ে উঠবে দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক ব্যাংকিং সেবার আওতা বাড়িয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারবে। মার্জারের ফলে খরচ কমবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে এবং দক্ষ মানবসম্পদের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। সার্বিকভাবে, ব্যাংক মার্জার দেশের ব্যাংকিং খাতে কার্যকারিতা, স্থিতিশীলতা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই একীভূতকরণ উদ্যোগটি সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর পৃথকভাবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন তাদের একত্রিত করে একটি সুসংগঠিত কাঠামোর অধীনে আনলে ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দক্ষতা বাড়বে।