সামান্তা শারমিন। আজ আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। নতুন রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক সংগ্রামের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইবরাহীম খলিল।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে এই সময়ে এসে নতুন রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা কতটুকু।

সামান্তা শারমিন : দেখুন রাজনৈতিক দল এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ‘অলরেডি ঠু লেট’ (বরং দেরি হয়ে গেছে)। কারণ ৫৩ বছর ধরে আমরা যে অবস্থায় আছি, নানান ধরনের বাইনারি লাইন হয়ে যাচ্ছে। এখন এই বাইনারি লাইন রিমুভ হওয়া দরকার। কারণ হচ্ছে এধরনের বাইনারির মধ্যে পড়লে মানুষের যে গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটা হরণ হয়ে যায়। আর পার্টি এক ধরনের মনোপলি হয়ে যায়। আগে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছিল। এখন আওয়ামী লীগ নেই। কিন্তু বিএনপি আছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও আছে; যারা জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এখানে যদি নানান মাত্রার রাজনৈতিক শক্তি থাকে, আর সেখানে যদি অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দল না হয়, তাহলে অভ্যুত্থানকে ধরে রাখা একটা পার্ট। আমি বলতে চাচ্ছি, অভ্যুত্থানকে ধরে রাখার নানা ফরমেট আছে। সেটা হতে পারে সাংস্কৃতিকভাবে, সামাজিকভাবে, হতে পারে রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যেভাবে ধরে রাখা সম্ভব, তার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো রাজনৈতিক দল দিয়ে এটাকে সমুন্নত রাখা। বিপ্লবের শক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। আমরা যদি এটার সম্ভাবনার জায়গাটা দেখি তবে বলবো, বাংলাদেশে ইয়াং ফোর্সের একটা রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। দলগতভাবে রাজনীতির পরিম-লে আমাদের দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীকে পেশীশক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু যখন একটা বড় পট পরিবর্তনের ব্যাপার থাকে, তখন তাদের মাধ্যমেই বিষয়টা ঘটে থাকে। এই পট পরিবর্তনের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে এই তরুণরা। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় রাজনৈতিকভাবে কর্তা ব্যক্তি হয়ে ওঠার জায়গাটায় তারা অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে যায়। আমরা মনে করি নতুন যে রাজনৈতিক দল আসবে তাদের সম্ভাবনার জায়গাটা খুব ভালভাবে কাজ করবে। সেইসাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতো পুরোপুরি সংস্কার হওয়ার কথা। নতুন বাংলাদেশের যে আকাক্সক্ষা, সেটা নতুন রাজনৈতিক দল ধারণ করবে। আমি বলবো ধারণ করা আর পালন করা হয়তো এক হবে না। এর জন্য একটা রাজনৈতিক লড়াই আছে। কিন্তু সম্ভাবনার জায়গাটা দেখতে গেলে, যেহেতু একটা ইয়াং ফোর্স কাজ করবে, এটা অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দল হবে, রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বলা হচ্ছে, এখানেই সম্ভাবনা মানে রাজনৈতিকভাবে সফল হওয়া ও রাজনৈতিকভাবে ভাল করার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দৈনিক সংগ্রাম : এখানে কি আপনারা শুধু তারুণ্যের মধ্যেই থাকছেন ? না কি সব বয়সি মানুষ এখানে সংযুক্ত হবে।

সামান্তা শারমিন : রাজনৈতিক দলের মধ্যে সব বয়সের মানুষকেই সম্পৃক্ত করতে হবে। তা না হলে ইনক্লুসিভ হবে না। কিন্তু আমরা যেটা চাচ্ছি সেটা হলো যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা, তারপর হলো টপ লিডারশীপ এই জায়গাগুলোতে ইয়াংরা থাকবে। আমাদের দেশে অন্য পার্টিগুলোতে দেখা যায়, যারা একটু বয়স্ক বা বয়স হয়ে গেছে কিংবা রাজনৈতিকভাবে প্রবীণ হয়েছেন তাদেরকে স্থায়ী কমিটি ইত্যাদি জায়গাতে দেখা যায়। আমরা চাইবো এখানে পুরোপুরি নতুন মুখ এমবিসাস মুখ, তরুণ মুখ, তারা থাকবে।

দৈনিক সংগ্রাম : এখানে একটা বিষয় জানতে চাই, আপনারা কি এখনো ছাত্র না কি তরুণ হয়ে গেছেন ?

সামান্তা শারমিন : এখানে ছাত্ররা দল গঠন করছে। বিষয়টা গুরুত্ব পাচ্ছে একারণে যে, ছাত্ররা অভ্যুত্থানটা করেছে। একারণে এটা বলা খুব স্বাভাবিক। যেমন নাহিদ ইসলাম, তারপর আসিফ মাহমুদ, মাহফুজ আলম বলেন, এখানে সারজিস-হাসনাত যারাই আছেন, তারাতো বেশি দিন হয়নি ছাত্রত্ব শেষ করেছে। আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে তাদের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর আমরাতো খুব বেশি দিন হয়নি ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েছি। আসলে ছাত্রত্বের গন্ধ এখনো আমাদের গা থেকে যায়নি। আবার আমাদের এখানে সরাসরি ছাত্ররাও আছেন। কিন্তু রাজনীতি করতে চান।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদের দলের পাঁচটি অগ্রাধিকারের কথা বলেন।

সামান্তা শারমিন : আসলে আমাদের মূলনীতি ওইভাবে ঠিক করা হয়নি। প্রথমত; আমাদের সংবিধানের মূল নীতি এখন যেটা আছে, সেগুলোতো আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করছি। এক্ষেত্রে জাতিগতভাবে আমাদের একটা ঐক্যবদ্ধতা এখনো আছে। আমরা মনে করি বাংলাদেশের যে জনগোষ্ঠী, জাতি হিসেবে গড়তে হলে কিছু বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতেই হবে। সেটা প্রাধান্যের ভিত্তিতেই দেই বা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেই, যেভাবেই করি না কেন, কাজটা করা প্রয়োজন। সেখানে অবশ্যই শিক্ষা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমরা দেখি শিক্ষার নানান মাত্রা রয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষা বলতে এখানে পাশ্চাত্যের শিক্ষাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। শিক্ষায় এখানে নানান মাত্রা আছে। মাদরাসা শিক্ষা আছে। বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং অন্য শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক আছে। মোট কথা হচ্ছে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সকল ধরনের শিক্ষাকে মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসা।

দ্বিতীয়ত; বাংলাদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়লেও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আমাদের হাসপাতালগুলোর মুমূর্ষু দশা। শিক্ষার পরেই জনস্বাস্থ্য ইস্যুটা আসে। জনস্বাস্থ্যের মধ্যে আরেকটা বিষয় আছে। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যটাকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ প্রচ- পরিমাণে ট্রমাটাইজ। ট্রমাটাইজ অবস্থা থেকে তাকে উত্তরণের জন্য সামাজিকভাবে পরিবর্তন দরকার, সেইসাথে প্রায়োরিটি বেইসিসে এই জায়গাটাকে এখনই ফোকাল পয়েন্ট করা দরকার। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত পানি এবং জলবায়ু। আমাদের জলবায়ুর যে পরিস্থিতি বাংলাদেশে; এটা কখনোই মেইনস্ট্রিম রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠেনি এবং এটা এনজিও’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে জলবায়ু এখানে মুখ্য ভূমিকায়। এবিষয় নিয়ে আলাপ করা রাজনীতির মুখ্য ভূমিকায় আসা উচিত। কারণ আমরাতো ৭শ’ নদীর দেশ। সাত শ’ নদীর দেশে আপনি দেখেন আমাদের পানি কিনে পান করতে হয়। শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, পানি ও জলবায়ুকে আমরা প্রাধান্য দেবো।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা যে প্রত্যাশা দিয়ে জনগণের কাছে গেছেন, তাদের একত্রিত করে বিপ্লব সাধন করেছেন। বৈষম্যহীন দেশ কিভাবে গড়বেন ?

সামান্তা শারমিন : বৈষ্যমহীন দেশ গড়া শুধু একটি পার্টির কাজ না। এটা একটা গোষ্ঠীর কাজ না। এবং এটা কখনোই সম্ভব হবে না; যদি না সকল ধরনের জনগোষ্ঠী, সকল নৃ-গোষ্ঠী, সকল জাতিসত্তা, সকল ধর্ম, সকল মত, সকল লিঙ্গ, সকল পেশা, সকল শ্রেণিকে। তাদের যদি পলিটিক্যাল করা না গেলে, এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমরা এটা মনে করি না যে কোন সিঙ্গেল পার্টিকে দিয়ে এটা সম্ভব। এজন্য সকল রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে আমরা একটা কথা বলি যে, আমরা রাজনীতি করি সকল রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। যেমন, দেখবেন, যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে সেটা পরিবর্তনের কথা বলি। কারণ এখানে কোনদিন শান্তিপূর্ণ পাওয়ার হ্যান্ডওভার হয়নি। রক্তক্ষয়ী পাওয়ার ট্রান্সফার হয়েছে। মারা গেছেতো আাওয়ামী লীগের কর্মী, বিএনপির কর্মী, জামায়াতের কর্মী। কিন্তু এটাতো বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক চরিত্র। আমরা মনে করি যে, দেশের রাজনীতির জন্য এই চরিত্রটা খারাপ, রাজনীতিকতার জন্য খারাপ। আমরা মনে করি যে, এই চরিত্রটা পরিবর্তন হওয়া দরকার; যাতে সকল রাজনৈতিক দল উপকৃত হয়। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, সব রাজনীতিক এটা নিয়ে কথা বলে না। আমরা যখন বলি বৈষম্যহীন সমাজ, বাংলাদেশের সকল সেক্টরে একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বিষয়ে সামাজিক ঐক্যে আসতে হবে। তাদের ঐকমত্য হতে হবে; যাতে করে এখানে যে বিষয়গুলো না হলেই না, গণতন্ত্র নিশ্চিতের ক্ষেত্রে, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে, মানুষের অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে, যে বিষয়গুলো না হলেই না। তারপর হচ্ছে পার্টি পলিটিক্স। কিন্তু পার্টি পলিটিক্স এখানে মুখ্য হতে পারে না। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য প্রথমত প্রায়োরিটি সামাজিক এবং রাজনীতিক প্রাধান্য পরিবর্তন করা প্রয়োজন।