পেঁয়াজের বাজারে টানা পাঁচ মাসের অস্থিরতা ভোক্তাদের আবারও ভোগালেও দেশের কৃষি উৎপাদনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। চলতি মৌসুমে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি প্রায় বন্ধ থাকলেও, দেশীয় উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই দেশের মোট চাহিদার প্রায় পুরোটাই যোগান দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি অতীতের তুলনায় একটি বড় ধরনের সাফল্য।
দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ লাখ মেট্রিক টন। কৃষকরা উৎপাদন করেন প্রায় ৩২ লাখ টন। বাকি ৭-৮ লাখ টন আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো, যার প্রায় ৯৯ শতাংশই আসত ভারত থেকে।
চলতি বছর ভালো ফলন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দেশীয় কৃষিপণ্য-সহায়ক নীতির কারণে পেঁয়াজ আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এবার দেশীয় পেঁয়াজ দিয়েই প্রায় পুরো বছর পার করা গেছে। তবে, বাজারে সামগ্রিক চাহিদাও আগের মতো না বাড়ায় আমদানির প্রয়োজন কম অনুভূত হয়েছে।
বাজারে দামের চাপ অব্যাহত
চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ একসময় ভারতীয় পেঁয়াজের মূল সরবরাহ কেন্দ্র ছিল। গত আগস্ট থেকে দাম বাড়তে থাকলেও ভারতীয় পেঁয়াজ আর প্রবেশ করেনি। গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে দেশী পেঁয়াজ যেখানে ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল, শনিবার তা আরও বেড়ে ১৪০-১৬০ টাকায় পৌঁছে যায়। মেহেরপুরের আগাম ফলন বাজারে এলেও দামে কোনো স্বস্তি আসেনি।
খাতুনগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে দেশি পেঁয়াজের মজুত প্রায় শেষের পথে। আড়তদার মো. ইদ্রিসের ভাষ্যমতে, “ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকা এবং মোকামে পেঁয়াজ না থাকার কারণেই বাজারে স্বল্পতা তৈরি হয়েছে।”
আমদানি কমেছে ৯৮ শতাংশ
নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ মাঠে উঠলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে মোকামে আসতে আরও দুই সপ্তাহ এবং খুচরা বাজারে পৌঁছাতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তাই জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম কিছুটা চাপে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে আমদানি কমেছে প্রায় ৯৮ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাত্র ২০ হাজার টন এবং জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত এসেছে মাত্র ১৩ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ। অন্য দেশ থেকেও আমদানি ছিল খুবই সীমিত।
চাক্তাই আড়তদার সংগঠনের নেতা মো. ফোরকান বলেন, “দেশীয় পেঁয়াজ দিয়েই পুরো বছর ব্যবসা টিকে আছেÑএটি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে আমদানি থাকলে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, যা দাম স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।”
স্বনির্ভরতার পথে বাংলাদেশ
অতীতে ভারত হঠাৎ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে তীব্র অস্থিতিশীলতা দেখা দিত। কিন্তু এবার আমদানির প্রয়োজন প্রায় শূন্যে নেমে আসায়, সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতার পথে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ মেট্রিক টনের মতো, যা আগের বছরের চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি। তবে সংরক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাজারে এসেছে ৩৩ লাখ টন।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়া এবং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির কারণেই এই ঘাটতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তারা আশা করছেন, এ মৌসুমেও ফলন ভালো হলে আগামী বছরেও বাংলাদেশ পেঁয়াজ সংকটমুক্ত থাকতে পারবে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট যাতে সক্রিয় হতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারের নজরদারি জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন আড়তদাররা।