বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে একদিকে নতুন ধান উঠার উৎসব চলছে। অন্যদিকে এই নতুন ধান বিক্রয় করতে গিয়ে মিলছে না দাম। এই বাজার বেজায় নি¤œমুখি। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহত্তর রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে আমন ধান কাটা-মাড়াই প্রায় শেষ হওয়ার পথে। কথা বলে দেখা যায়, নতুন ধান ঘরে উঠলেও কৃষকের মনে নেই কোন উৎসাহ। ডিসেম্বর মাস চলছে। সার-কীটনাশকসহ সব দোকানে দোকানে চলছে হাল খাতা। বর্তমানে আমন ধানের দর বাজারে একেবারে নি¤œমুখি। এতে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন ফিকে হতে বসেছে। বাজারে দাম কম হওয়াই হতাশায় ভুগছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা।
আমনের কাটা-মাড়াইয়ের শুরুতেই সরকার আমনের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রতিমণ ১ হাজার ৩৬০ টাকা দরে। সরকারিভাবে আমন কেনাও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্ত সরকারের বেঁধে দেয়া দর বাজারে প্রভাব ফেলছে না। বাজারে প্রতিমণ ধান ১ হাজার ১০০ টাকা হতে এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যা গত বছর এ সময় প্রতিমণ ধানের বাজার ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রতি মণে দুইশত টাকা কম পাচ্ছেন কৃষক। তারা বলছেন, ডিসেম্বর মাসে সব দোকানে হালখাতা শুরু হয়। এ সময় কৃষকেরা ধান বিক্রি করে তা পরিশোধ করে থাকেন। কিন্ত ধান ব্যবসায়ীরা ধান কিনতে অনেকটা অনীহা দেখাচ্ছেন। একাধিক স্থানীয় ধান ব্যবসায়ী বলছেন, পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের ধান কিনে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তারা এই ধান বিক্রি করেন মিলের মালিকদের কাছে। কিন্ত চলতি আমন মৌসুমে মিলমালিকেরা ধান কিনতে দৃশ্যত অনীহা দেখাচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আড়তে অনেক ধান আটকা পড়ে থাকায় তারা কৃষকের ধান খুব বেশি কিনতে পারছেন না। স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকার নামমাত্র ধান ক্রয় করে। দেশের ৯০ ভাগ ধান কিনে থাকেন অটো মিলমালিকেরা। তাই দামও নির্ধারণ করেন মিলমালিকেরাই। তাদের ইচ্ছামত দামে ধানের দর নির্ধারণ করে ক্রয় করেন। মিলমালিকেদের একটি বড় সিন্ডিকেট কাজ করে। এতে মিলমালিকদের লাভের পাল্লা ভারি হলেও হাজার হাজার কৃষকের কষ্টের ফসল চলে যায় সিন্ডিকেটের পকেটে।
চলতি ২০২৫-২৬ আমন মৌসুমে সরকার প্রতি কেজি সেদ্ধ চাল ৫০ টাকা, আতপ চাল ৪৯ টাকা এবং ধান ৩৪ টাকা দরে কিনবে, যা গত বছরের তুলনায় বেশি এবং এই ধান ও চাল সংগ্রহ ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে, যার লক্ষ্যমাত্রা মোট ৭ লাখ টন। তবুও সরকারের দেয়া দরের প্রভাব পড়ছে না বাজারে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে আবারো ধানের দাম নি¤œমুখি। এতে বড় লোকসানের মুখে পড়ছেন কৃষকরা। এতে ক্ষোভ বাড়ছে কৃষকদের মধ্যে। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ৮০ ভাগ ধান ক্রয় করে থাকেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার মিল মালিকেরা। স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল-মালিকেরা ধান ক্রয় করতে যে দর বেঁধে দিচ্ছে সে দর দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আর কৃষকরা বলছেন, সরকারে দেয়া দরের কোনো প্রভাব বাজারে নেই। বর্তমানে যে দরে ধানের বাজার চলছে তাতে করে উৎপাদন খরচ তো উঠবে না, বরং ঘর থেকে অন্য কিছু বিক্রি করে গচ্চা দিয়ে মহাজনের দায় পরিশোধ করতে হবে।
কৃষকেরা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে উচু-নিচু ক্ষেত প্রায় ৭০ ভাগ জমি বৃষ্টিপানির উপর নির্ভর করে আমন চাষাবাদ করে থাকেন কৃষকেরা। আমনের মাঝামাঝি সময়ে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। তাই অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করায় কৃষকদের খরচ হয়ে যায় দ্বিগুন। এছাড়া কার্তিক মাসে ঘুর্ণিঝড় বড় ও বৃষ্টিতে ধান নুয়ে পড়ে যায়। এখন ঘরে নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। ঘরে ধান উঠলেও পর্যপ্ত ফলনও হচ্ছে না। বাজারে নতুন ধানের দামও কয়েক বছরের তুলনায় কম থাকায় চিন্তায় পড়েছেন তারা। কৃষকেরা জানান, প্রতি বিঘায় গড়ে ধান ফলন হচ্ছে কেজির মাপে ১৪ থেকে ১৬ মণ করে। গত বছর হয়েছিল ১৮ থেকে ২০ মণ।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর গ্রামের একজন কৃষক জানান, ১৬ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চলতি মৌসুমে আমন চাষাবাদ করেছিলেন তিনি। মাঠে ধান ভাল থাকায় বুকে অনেক স্বপ্ন বেঁধেছিলেন। জমির ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। হিসাব করে দেখেন তার বিঘাপ্রতি ১৬ মণ করে ফলন হয়েছে। আর মহাজনকেই দেয়া লাগছে প্রতি বিঘায় ১০ মণ ধান। যে টুকু থাকে বাজারে ধানের দরের যে অবস্থা তাতে বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারবো না। ঘর থেকে গচ্চা দেয়া লাগবে। গোদাগাড়ী উপজেলার চানন্দালায় গ্রামের আরেক কৃষক বলেন, চলতি বছর কীটনাশক প্রয়োগে আমন উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। এমনিতেই ফলন কম হচ্ছে তার পরে বাজারে ধান পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে কীটনাশক দোকানে হালখাতা। ধান বিক্রি করে পরিশোধ করা লাগবে। রাজশাহীর অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা যায় হাটগুলো নতুন ধানে ভরপুর হয়ে আছে। কৃষকেরা ধান বিক্রি করতে এসেছেন। কিন্ত ধানের ক্রেতা নেই বললেই চলে। মণ প্রতি ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ মধ্যে দাম ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে একাধিক মিলমালিক বলেন, আমনের ভরা মৌসুমে সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানি শুরু করেছে। তাই বাজারে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। আমাদের কিছুই করার নাই। সরকার দুইমাস চাল আমদানি বন্ধ করলে কৃষকেরা ভাল দাম পাবে।