কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ভোজ্য তেল সয়াবিনের বাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে সোয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী থাকলেও বাংলাদেশের বাজারে দফায় দফায় বাড়ছে। জানা গেছে, একটি সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপে বারবার বাাড়ানো হচ্ছে সোয়াবিনের দাম। এবার বাাড়নো হয়েছে একলাফে ৬ টাকা। আর ফামঅয়েলে বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দেশে যে পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। তা আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় বেশি। তাহলে সয়াবিন তেলের দাম বাড়বে কেন? ভোক্তারা বলছেন, দাম বাড়াতেই সিন্ডিকেট চক্র বারবার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে।

বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ছয় টাকা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া প্রতি লিটার পাম তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৩ টাকা। তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে খোলা সয়াবিন তেলের দাম। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

সূত্রমতে, গত আগস্টে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ নিয়ে সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ব্যবসায়ীরা ১০ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের মাত্র এক টাকা বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছিল। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হন এবং সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এ বিষয়ে কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমকে জানাননি। তবে নতুন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৮৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৫ টাকা, খোলা সয়াবিনের দাম তিন টাকা বাড়িয়ে ১৭৭ এবং পাম তেলের দাম ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১৬৩ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৪৫ টাকা। দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ছয় টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৯৫ টাকায়। এত দিন যা ১৮৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

গতকাল ভোজ্যতেল পরিশোধন ও উৎপাদনকারী কোম্পানিদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এই দাম মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুনরায় বৈঠক হয়। বৈঠকে সয়াবিন তেল ও পাম তেলের নতুন দাম নির্ধারণ হয়। তবে এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে মন্ত্রণালয় এখনো অনুমোদন দেয়নি। তার আগেই ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। তবে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী একটি কোম্পানির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দাম বাড়ার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের অনুমোদন দিয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত এপ্রিল মাসে সর্বশেষ সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা করা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৬৯ টাকা এবং বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৭০ টাকা বাড়িয়ে ৯২২ টাকা করা হয়। অবশ্য আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে এসে খোলা পাম তেলের দাম লিটারে ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা করা হয়। আগস্টেই ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১০ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তবে তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের মাত্র এক টাকা বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছিল। এ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। এরপর গত ২২ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে কবে বা কত বাড়ানো হবে, সেই বিষয়ে ওই সময়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর গতকাল পুনরায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল্য বাড়ানোর ঘোষণার পরই বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও বললেই চলে। পাঁচ-ছয়টি দোকান ঘুরে মিলছে একটিতে, তাও দাম গুনতে হচ্ছে বেশি। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলেও একই অবস্থা। বোতলজাত তেল না থাকায় গতকাল রাতে অনেকেই খোলা তেল কিনে বাসায় গিয়েছেন। তবে দাম বাড়তিটাই নেয়া হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

হঠাৎ কেন এমন সংকট- জানতে চাইলে মুখ খুলছে না ব্যবসায়ীরা। তারা কথা বলছেন না কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে। তবে সূত্র জানায়, তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণার সাথে সাথে তের উদাও হয়ে গেছে। অনেকেই তেল সরিয়ে ফেলেছেন। থাকলেও বিক্রি করছেন না। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলে কেউ কেউ বাড়তি দাম আদায় করে নিচ্ছেন।

গতকাল সন্থ্যায় ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ তেল নিয়ে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক থেকে দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে। ক্রেতারা যে দু-একটি বোতল পাচ্ছেন, তারও দাম রাখা হচ্ছে বেশি। ঢাকার মধুবাগ এলাকায় প্রায় দশটি দোকান ঘুরে সেখানে একটি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হতে দেখা গেছে। একটিতে ছিল খোলা সয়াবিন। এদিকে বেশিরভাগ সুপারশপেও তেলের সংকট দেখা গেছে। রামপুরা স্বপ্ন সুপারশপে কোনো সয়াবিন তেল ছিল না বলে অনেকেই ফোনে জানিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় তেল বিক্রি করছেন না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কোম্পানিগুলো তেল ভোক্তাদের সঙ্গে নৈরাজ্য করছে। তাদের সরবরাহ ও মজুত খতিয়ে দেখা দরকার।

সূত্র মতে, গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরে ভোজ্যতেল শিল্পে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এ বাজারের একটি বড় অংশীদার এস আলম গ্রুপ তেল সরবরাহ থেকে সরে গেছে। বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজারে ১০ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তবে নিয়ন্ত্রণ টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও বসুন্ধরার কাছে। এ চার কোম্পানি আমদানি করা ভোজ্যতেলের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশে এখন বছরে ৩০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। যার দুই-তৃতীয়াংশ এসব কোম্পানি আমদানি করছে। বাকিটা দেশে উৎপাদন ও অন্য কোম্পানি আনছে। ফলে ভোজ্যতেলের বাজারে চলমান সংকটে এ চার কোম্পানিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ।