"বৈষম্য দূরীকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার" শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক আজ (১৫ নভেম্বর) সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য প্রফেসর ড. শাহজাহান খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।

বৈঠকে বক্তারা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন এবং এর নিরসনে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য’ ছিল প্রধানতম অঙ্গীকার। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদেও সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। তবে বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সম্পদ বণ্টনে তীব্র বৈষম্য বিরাজমান। জরিপে দেখা যায় দেশের বিত্তবান ১০% মানুষ ৫৮.৫% সম্পদের মালিক, যেখানে কম সম্পদশালী ৫০% মানুষের মালিকানা মাত্র ৪.৮%। উচ্চবিত্ত ১০% ব্যক্তি মোট জাতীয় আয়ের ৪১% থেকে ৩৮.৫০% এর অধিকারী, পক্ষান্তরে সমাজের নিম্ন আয়ের ১০% লোক মোট জাতীয় সম্পদের মাত্র ১.৩১% ভাগের অংশীদার।

বৈষম্যের অন্যান্য কারণ হিসেবে দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য বিস্তার, ব্যাংক লুটপাট, ঋণ খেলাপী ও অর্থ পাচারকে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজার (৮৫% ভাগ) এবং শহর-কেন্দ্রিক বিনিয়োগ বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

আলোচকরা বলেন, প্রায় ২০টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে দারিদ্র্যের হার কমলেও, এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছে না।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে কমে দাঁড়িয়েছে ১১৬,৭৩১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪.৭৮% ভাগ।

বক্তারা উল্লেখ করেন, সরকার এখাতে জিডিপি-র ২.০০% থেকে ২.৫০% ব্যয় বরাদ্দ দাবি করলেও, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয় হিসাবের সুদ ও বিভিন্ন সাবসিডি বাদ দিলে প্রকৃত বরাদ্দের হার জিডিপি-র মাত্র ১.৩২% ভাগ। এই 'শুভঙ্করের ফাঁক' দূর করার আহ্বান জানানো হয়।

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বক্তারা রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও নীতিগত সংস্কারের ওপর জোর দেন। অতিথিরা বলেন, ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ১ লাখ কোটি টাকা যাকাত সংগ্রহ করা সম্ভব। এই বিপুল সম্ভাবনাময় খাতকে কাজে লাগানোর জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যাকাত, ওয়াকফ, সাদাকা প্রভৃতি ইসলামী সামাজিক অর্থায়নের সকল ইনস্ট্রুমেন্ট সমন্বিতভাবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বক্তারা দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, বৈষম্য দূরীকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সংবিধানের মূল চেতনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে নীতি ও কাঠামোগত সংস্কারে হাত দিতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:

নাজিম উদ্দিন আলম, সাবেক এমপি (বিএনপি), মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী), মজিবুর রহমান মঞ্জু (এবি পার্টি), ড. আতিক মুজাহিদ ও আশরাফ উদ্দিন মাহদী (জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপি), রাফে সালমান রিফাত (আপ বাংলাদেশ), আবদুল মাজেদ আজহারী ও মুফতী মুখলিসুর রহমান কাসেমী (বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি), ফাতেমা তাসনীম জুমা ও আনাস ইবনে মুনির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ - ডাকসু), কর্নেল (অবঃ) মোহাম্মদ আব্দুল হক (রাওয়া ক্লাব)। মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ (চেয়ারম্যান, এসডিএফ), প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম (সাবেক উপাচার্য, পবিপ্রবি), ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া (অধ্যাপক, বুয়েট), ড. হাসিনা শেখ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা (নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়) মাসুমুর রহমান খলিলী (নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত) প্রমুখ।