বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাট করা বিদ্যুৎখাতকে সংস্কার করার কাজে হাত দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগ এখাত থেকে বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে ও নিয়ম নীতি দোহাই দিয়ে কোটি কোটি টাকা লুট করেছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে নুতন করে না ঘটে সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।

সূত্র জানায়, দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুত কেন্দ্র বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ । এরমাধ্যমে ভর্তুকির নামে কোটি কোটি টাকা লুট হয়েছে। সর্বশেষ হিসেব মতো বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি ৬২ হাজার কোটি টাকা। এটাকা যাতে আগামীতে না দিতে হয় সেজন্য পর্যায়ক্রমে তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এমন বাধ্যবাধকতার বিষয় উঠে এসেছে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি বৈঠকে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে বিদ্যুৎ খাতকে ভর্তুকি মুক্ত করার রোডম্যাপ আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত করতে হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা বলেন, ভর্তুকির বিষয়টি নিয়ে কমিটি কাজ করছে। মিটিংয়ে তাদেরকে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।

এর আগে, আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ২০২৪ সালের মার্চে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে আবার কমে গেলে কমবে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার বিদ্যুৎখাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের শর্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে ব্যর্থ হলে আইএমএফ’র পরবর্তী ঋণের কিস্তি ছাড়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে।

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৩ বছরের মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ জমা দিতে বলা হয়েছে। সরকার নিজে উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি এবং বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে। বর্তমানে গড় উৎপাদন খরচ প্রায় ১২ টাকার মতো পড়লেও ৭ টাকা ৪ পয়সা দরে বিক্রি করছে। এতে করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৫৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।

বৈঠকে আরেকটি সুপারিশ এসেছে টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে সরকার যেভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যপণ্য দিচ্ছে। ওই কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে বিদ্যুৎ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, হতে পারে নগদ সহায়তা। গ্রাহক পর্যায়ের পাশাপাশি সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার দিকে নজর দিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এ জন্য বিদ্যুতের ক্রয় চুক্তি রিভিউ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিনিধিরা কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন, যাতে প্রকৃত ঝুঁকিপূর্ণ গ্রাহকদের সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায়। সরকারের লক্ষ্য হলো বার্ষিক বাজেটভিত্তিক ভর্তুকির পরিবর্তে সরাসরি নগদ সহায়তা নিশ্চিত করা। গত আগস্ট পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৮৮ লাখ। লাইফলাইনের ১ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ১ কোটি ৬৩ লাখ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতায় পড়েন।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। গত ১৬ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট। অথচ দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্র বানিয়েছিল। ফলে উৎপাদন না করেও কেন্দ্র মালিকরা প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা সরকার থেকে পেয়েছেন, যার প্রভাবে বেড়েছে বিদ্যুতের খরচ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিডিবির বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট কিনতে লেগেছে ১১ টাকা ৭৪ পয়সা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৬ টাকা ১৮ পয়সা। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরে খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। এ চাপ সামলাতে তৎকালীন সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।

২০০৯ সালে বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। এখন হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। এর পরও উৎপাদন খরচের সঙ্গে খুচরা দামের সমতা হয়নি। পিডিবির লোকসান কমাতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবির ভর্তুকি ছিল ৭ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। ভর্তুকি বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ হাজার ৮০০, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৫১১, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৪০০ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি ৬২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।

আইএমএফ বলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ-গ্যাস মিলে ভর্তুকি ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৩২ শতাংশ। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাজেটের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশে বিদ্যুতের প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ (লাইফলাইন) গ্রাহক প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। তারা খুবই কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। সরকার নির্ধারিত বিশেষ মূল্যহারে (অন্যদের তুলনায় কম) বিদ্যুৎ বিল দেন তারা। এই গ্রাহকদের নগদ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মতো এটি বাস্তবায়িত হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুসারে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের মতে, সরকার বছরে বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দেয়, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে এর বড় অংশই ধনীরা ভোগ করছেন। গরিবরা পান ছিটেফোঁটা। এই বৈষম্য দূর করতেই প্রান্তিক গ্রাহকদের নগদ সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে অন্য গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল কিছুটা বাড়তে পারে।

সূত্র জানায়, বিদ্যুতের ব্যবহারের পরিমাণ ভেদে ৬টি স্ল্যাব (স্তর) বিদ্যমান রয়েছে। এরমধ্যে একটি স্তর রয়েছে ৫০ কিলোওয়ার্ট আওয়ার, যাদেরকে লাইফলাইন গ্রাহক বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ওই স্তর পদ্ধতি চালু করেছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল যাদের বিদ্যুতের ব্যবহার কম তারা তুলনামূলক কম দাম দেবেন। অর্থাৎ যারা ফ্রিজ, এসির মতো বিলাসী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে তারা ধনিক শ্রেণি তাদের বিদ্যুতের বিল বেশি হবে। আর গ্রামের দরিদ্র পরিবারটি যারা একটি লাইট ও একটি ফ্যান ব্যবহার করে তাদেরকে ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। এখানে বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

সরকারি মালিকানাধীন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির চুক্তি রিভিউয়ের কাজ চলমান রয়েছে। কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে করে গড় উৎপাদন খরচ কমে আসবে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ****

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছে সুষ্ঠু পরিকল্পনার কথা। যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তুলনামূলক দক্ষ সেগুলোর উৎপাদন বেশি করা। বিশেষ করে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জোর দেওয়া। যদিও লিস্ট কস্ট জেনারেশনের কথা বলা হয়,অর্থাৎ যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাশ্রয়ী সেগুলো আগে চালানো কথা। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন, ১৭ সেপ্টেম্বরও মেঘনাঘাটে দক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে তুলনামূলক অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। আবার সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সাশ্রয়ী খ্যাত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পুরোমাত্রায় চালানো যাচ্ছে না। ক্যাব মনে করে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া গেলে বিদ্যুতের খরচ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।

গত জুন মাসে সরকারের কাছে জমা দেওয়া আইএমএফের কারিগরি সহায়তা-সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির মূল সুবিধাভোগী ধনী গ্রাহকরা। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে দেওয়া ভর্তুকির মাত্র ১২ শতাংশের সুবিধাভোগী সবচেয়ে গরিবরা (প্রান্তিক গ্রাহক)। বিপরীতে ৩২ শতাংশের সমপরিমাণ পাচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ গ্রাহক। ধনী গ্রাহকদের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। বৈষম্যমূলক কাঠামোর কারণে নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি করছে। এই প্রতিবেদনেই সংস্থাটি ভর্তুকি কমাতে কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি প্রয়োজনে সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।