বিদ্যুত-জ্বালানি
অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে আ’লীগ
গরমে লোডশেডিং কমাতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নীতিতে চলার সিদ্ধান্ত সরকারের
গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের সংকট নিরসনে আপাতত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নীতিতে হাঁটছে সরকার। আসন্ন সংকট মোকাবিলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিতেও দেখা গেছে সরকারকে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও বাড়িঘরে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি না চালানোর নির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
Printed Edition
গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের সংকট নিরসনে আপাতত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নীতিতে হাঁটছে সরকার। আসন্ন সংকট মোকাবিলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিতেও দেখা গেছে সরকারকে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও বাড়িঘরে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি না চালানোর নির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি পরিপত্র জারি করেছে সরকার। যারা এই নির্দেশনা অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের মাধ্যমে লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ৩১ হাজার মেগাওয়াটের উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও সেটার অর্ধেক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। তারওপর বিদ্যুৎ আমদানির বকেয়াও পরিশোধ করতে হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার হিসেবেই বর্তমানে দেশে দৈনিক প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে দেশীয় উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে গ্যাসের সরবরাহ করা রয়েছে দুই হাজার আটশ' মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ দৈনিক প্রায় এক হাজার দুইশ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলোতে।
অন্যদিকে, ডলার সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় গ্যাস, কয়লা এবং জ্বালানি তেলের পুরোটা আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জ্বালানি সংকটে ইতোমধ্যেই বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো কেন্দ্র ধুকছে।
জ্বালানি বিষেশজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা দেখছি না। সংকটগুলো রয়েই গেছে। গত কয়েক বছর ধরেই বিদ্যুৎখাতের প্রধান সংকটের জায়গা হলো জ্বালানি।
আরেক জ্বালানি বিষেশজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, এর মধ্যেই এবার রোজা, সেচ মৌসুম এবং গরম একসঙ্গে শুরু হওয়ায় বিদ্যুতের ওপর বাড়তি চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা কতটুকু বাড়ে এবং সেই চাহিদা পূরণে সরকার বিদ্যুতের জ্বালানির যোগান কতটুকু দিতে পারেন, তার ওপর লোডশেডিং নির্ভর করবে।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে যে, এখন পর্যন্ত তারা দৈনিক সাড়ে বারো হাজার মেগাওয়াট চাহিদার পুরোটা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে। তারপরও অনেক এলাকায়, বিশেষত ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের এক থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতে দেখা যাচ্ছে। যদিও উপদেষ্টা বলছেন, কারিগরি ত্রুটির কারণেই কিছু এলাকায় বিভ্রাট দেখো যাচ্ছে।
সরকার বলছে যে, এখন পর্যন্ত তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছেন। তবে গরম বাড়তে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য আগেভাগেই সাশ্রয়ী নীতিতে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, এবছরেও গ্রীষ্মের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। তাই সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুতের জ্বালানির সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. এম শামসুল আলম বলেন, উৎপাদনের ক্যাপাসিটি আমাদের রয়েছে। এখন জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে কোনো সমস্যা থাকবে না। ফলে সরকারকে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারও বলছে যে, তারা ইতোমধ্যেই পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। এছাড়া কয়লার সরবরাহও যেন ঠিক থাকে, সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলছেন, চাহিদার তুলনায় এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন ঠিক আছে, সেটাই আমরা ধরে রাখতে চাই। সরকার বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, ওমানসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে গ্যাস আমদানি করছে। তিনি বলেন, আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা। ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৩৫টি কূপ খনন করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন সরকারের এই উপদেষ্টা।
২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যেন অসুবিধা না হয়, সেজন্য গরমকালে স্যুট-কোট পরিধান করে অফিসে না আসার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনাগুলো ঠিকমত মানা হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় শিগগিরই নজরদারি শুরু করবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা।
জানা গেছে, বাংলাদেশে শীতকালের তুলনায় গরমকালে সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এ বছর গ্রীষ্মে গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হতে পারে বলে ধারণা করছে সরকার। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতাও দেশটির রয়েছে। কিন্তু চলমান আর্থিক ও জ্বালানি সংকটের মধ্যে চাহিদার পুরোটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা কঠিন হবে না বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গ্রীষ্ম সামনে রেখে মার্চে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার এবং এপ্রিলে ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এবার এটি ১৩ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে। ঘাটতি পূরণে গত তিন বছরের মতো এবারের গ্রীষ্মে লোডশেডিং করতে হতে পারে।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে গ্রীষ্মের প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। বিদ্যুৎ–ঘাটতি মেটাতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ব্যবহারে সতর্ক করেছেন তিনি। এসি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে বলেও ১৭ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছেন উপদেষ্টা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে। গ্যাস ও কয়লা থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যদিও গ্যাস ও কয়লার সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। আদানির বাইরে আমদানি থেকে আসবে এক হাজার মেগাওয়াট। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে তেলচালিত কেন্দ্র থেকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে দু–তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি হতে পারে। এতে প্রতিদিন দু’তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হতে পারে গরমের সময়।
পিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড পিএলসি লিমিটেডের তথ্য বলছে, চাহিদামতো উৎপাদন করতে না পারায় গত নবেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত লোডশেডিং অব্যাহত ছিল। এরপর শীতের কারণে চাহিদা কমতে থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি হয়নি। গত তিন মাস বিদ্যুতের চাহিদা দিনে ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচে ছিল। ইতিমধ্যে এটি ১১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। আগামী মাসে এটি বাড়তে শুরু করবে।
ডিপিডিসির ৭ নির্দেশনা
এদিকে গ্রীষ্মকাল, সেচ মৌসুম এবং পবিত্র রমযান মাস একই সময়ে হওয়ায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গ্রাহকদের সাতটি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড-ডিপিডিসি। গতকাল বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রীষ্মকাল, সেচ মৌসুম এবং পবিত্র রমযান মাস একই সময়ে হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুতের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে সম্মানিত গ্রাহকগণ লোডশেডিং এর সম্মুখীন হতে পারে। লোডশেডিং মুক্ত থাকতে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান পবিত্র রমযান মাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সকল গ্রাহককে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে অনুরোধ করেছেন।
ডিপিডিসির সম্মানিত গ্রাহকগণকে লোডশেডিং মুক্ত থাকতে বিদ্যুৎ এর অপচয় রোধ ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে নি¤েœাক্ত বিষয়সমূহ প্রতিপালনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হচ্ছে:
১. মসজিদ, শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বাসাবাড়ি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এসি'র তাপমাত্রা ২৫ক্ক সেলসিয়াসের উপরে রাখুন।
২. বিদ্যুতের অপচয় রোধে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করুন।
৩. দোকানপাট, শপিংমল, বিপণি বিতান, পেট্রোল পাম্প ও সিএনজি স্টেশনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার পরিহার করুন।
৪. দিনের বেলায় জানালার পর্দা সরিয়ে রাখুন ও সূর্যের আলো ব্যবহার করুন। যে কোনো ধরনের আলোকসজ্জা করা থেকে বিরত থাকুন।
৫. পিক আওয়ারে রি-রোলিং মিল, ওয়াশিং মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিন, ওভেন ও ইস্ত্রির ব্যবহার বন্ধ রাখুন।
৬. ইজি বাইক, অটোরিকশা ইত্যাদি অবৈধভাবে চার্জিং হতে বিরত থাকুন। বাসা-বাড়িতে পরিবেশবান্ধব রুফটপ সোলারটিকে সচল রাখুন।
৭. জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় মানসম্মত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করুন।