দেশে গ্যাসের মজুদ ক্রমশ হ্রাস এবং চাহিদা বাড়তে থাকায় এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে মহেশখালীতে নতুন ভাসমান সংরক্ষণ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ স্থাপনা নির্মাণকাজে ৬টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোবাংলা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ (ইএমআরডি) বা উভয় সংস্থার কাছে প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
ওমানের ওকিউ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, সৌদি আরবের আরামকো ট্রেডিং, আজারবাইজানের সকার, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সেলারেট এনার্জি এবং রাশিয়ার নোভাটেকসহ কয়েকটি বৈশ্বিক জ্বালানি কোম্পানি এফএসআরইউ বা সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান জানান, আমরা ইতোমধ্যেই বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব পেয়েছি। তিনি বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন সক্ষমতার প্রয়োজন বিবেচনায় সরকার শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। নতুন প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান অথবা দ্বিপাক্ষিক সরকারি চুক্তির মাধ্যমে হতে পারে। তবে আগের প্রকল্পগুলোর চেয়ে কম খরচে কাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের দুই এফএসআরইউ প্রায় পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। এদের সম্মিলিত দৈনিক রিগ্যাসিফিকেশন সক্ষমতা ১ হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি), যা পূর্ণ সক্ষমতায় ১ হাজার ১০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সেলারেট এনার্জির টার্মিনাল প্রতিদিন ৬০০ এমএমসিএফডি এবং সামিট গ্রুপের এফএসআরইউ ৫০০ এমএমসিএফডি পর্যন্ত রিগ্যাসিফিকেশন করতে সক্ষম। তবে এ সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে হলে বছরে ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করতে হবে।
চলতি বছর প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ ১০৮টি কার্গো আমদানি করছে পেট্রোবাংলা। আরও সাতটি কার্গো আনার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে রাষ্ট্রীয় সার কারখানায় বাড়তি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। এরই মধ্যে জুন থেকে প্রতিদিন এক হাজার এমএমসিএফডির বেশি এলএনজি রিগ্যাসিফাই হচ্ছে।
নতুন এফএসআরইউ নির্মাণের আগে মহেশখালীতে বছরে ৪৫ লাখ টন (৪ দশমিক ৫ এমটিপিএ) সক্ষমতার একটি টার্মিনাল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে যাচ্ছে সরকার। অবকাঠামো বিনিয়োগ সুবিধা কোম্পানি (আইআইএফসি) দ্রুত এ সমীক্ষা করবে।
এর আগে সামিট গ্রুপকে একই স্থানে তৃতীয় এফএসআরইউ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়। ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ সামিটের সঙ্গে টার্মিনাল ইউজ এগ্রিমেন্ট (টিইউএ) ও ইমপ্লিমেন্টেশন এগ্রিমেন্ট (আইএ) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ‘বিল্ড-ওন-অপারেট-ট্রান্সফার’ (বিওওটি) ভিত্তিতে ১৫ বছরের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। দৈনিক ৩ লাখ ডলার ফি দেওয়ার শর্ত ছিল ওই চুক্তিতে।
সামিট ইতোমধ্যে প্রকল্পের জন্য সমুদ্রের আবহাওয়া ও ঢেউ-স্রোতের (মেট-ওশান) সমীক্ষা শেষ করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল।
বর্তমানে মহেশখালীতে সামিটের বিদ্যমান ৩ দশমিক ৭৫ এমটিপিএ ক্ষমতার এফএসআরইউ ২০১৯ সালের এপ্রিলে চালু হয়েছে এবং তা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত চলবে। অন্যদিকে এক্সেলারেট এনার্জির ৪ দশমিক ৫ এমটিপিএ ক্ষমতার এফএসআরইউ ২০১৮ সালের আগস্টে কার্যক্রম শুরু করে।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক মোট গ্যাস উৎপাদন ২৮২১ এমএমসিএফডি, এর মধ্যে ১০৩৩ এমএমসিএফডি এলএনজি রিগ্যাসিফাই করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে নতুন আরো একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জোর প্রস্তুতি নিয়েছে পেট্রোবাংলা। কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোমে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার টার্মিনালটি নির্মাণ করা হবে। শেষ পর্যায়ে রয়েছে প্রাক-সমীক্ষার কাজ।
দেশে বর্তমানে এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে দুটি, একটি পরিচালনা করছে সামিট গ্রুপ, অন্যটি মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। মহেশখালীতে অবস্থিত ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট (দৈনিক) সক্ষমতার দুটি টার্মিনালই ভাসমান। নতুন টার্মিনালটি হলে দেশে মোট ভাসমান এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা দাঁড়াবে ১ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বঙ্গোপসাগরে যদিও ভাসমান টার্মিনালে গ্যাস সরবরাহে বিঘœতা, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণ, এমনকি উচ্চ পরিচালন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। তাদের ভাষ্য, দেশে গ্যাস সরবরাহে ভাসমান টার্মিনাল বাংলাদেশের জন্য এখন আর উপযোগী নয়। কারণ বিদ্যমান দুটি টার্মিনালে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্যাস সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ঝুঁকি বাড়ছে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়ও। সরকারের উচিত টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ল্যান্ডবেজ টার্মিনাল নির্মাণের দিকে অগ্রসর হওয়া।
ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল অবকাঠামো ল্যান্ডবেজ বা ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনালের তুলনায় সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী। তবে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে এ ধরনের অবকাঠামো ঝুঁকি ও গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছরই বিঘœতা তৈরি করছে। ফলে কোনো দুর্ঘটনার কারণে এলএনজি বন্ধ হয়ে গেলে তা পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি করে। এতে শিল্প, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে উৎপাদন ব্যাহত ও লোডশেডিংয়ের মতো ঘটনাও ঘটে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে দৈনিক ৪ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে চাহিদা ও সরবরাহে গ্যাসের ঘাটতি অন্তত দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ ঘাটতি কমাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণ করে এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে চায় সরকার।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একজন র্শীষ কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে বড় আকারে গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনে যেতে পারছে না। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাহিদা ও সরবরাহে অন্তত ১ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে দ্রুত ও কম সময়ে সরবরাহ বাড়াতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন মহেশখালী ও পায়রায় আরো দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। এর মধ্যে গত বছরের মার্চে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণে সামিট গ্রুপের সঙ্গে বিশেষ আইনের অধীনে প্রাথমিক চুক্তিও করেছিল বিগত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। বর্তমানে এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। এ কারণে চতুর্থ টার্মিনাল নির্মাণে কাজ করছে জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন,এলএনজি দেশের জন্য একটি ব্যয়বহুল পণ্য। সেখানে ভাসমান কিংবা ল্যান্ডবেজ এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ মূলত আমদানি জোরদারের পরিকল্পনা। এগুলো আগের সরকারের নেয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ আকারে এ ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা সরবরাহ ও অর্থনীতিতে উভয় ঝুঁকি।