বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে কমছে জ্বালানি তেলের দাম। এ অবস্থায় গত চার বছরের মধ্যে তেলের দাম কমে এখন সর্বনিম্ন হয়েছে। ফলে কম দামে তেল আমদানির সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে দেশের বাজারেও এর দাম কমানোর সুযোগ আছে। তবে ভোক্তারা এখনই সুফল পাচ্ছেন না। এছাড়া এশিয়ার স্পট মার্কেটে এখনো ছয় মাসের সর্বনি¤œ দামে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বেচাকেনা হচ্ছে।

এশিয়ার স্পট মার্কেটে এখনো ছয় মাসের সর্বনি¤œ দামে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বেচাকেনা হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা জানান, এর পেছনে ভূমিকা রাখছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার আশঙ্কায় জ্বালানি পণ্যের চাহিদা কমেছে, যার প্রভাব পড়ছে দামে।

গত কয়েক বছরে জ্বালানি তেলের দামে বড় রকমের উত্থান-পতন দেখেছে বিশ্ব। করোনা মহামারির প্রভাবে তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েল) দাম ছিল গড়ে ৪২ মার্কিন ডলার। পরের বছর অস্থির হয়ে ওঠে তেলের বাজার। গড় দাম বেড়ে হয় প্রায় ৭১ ডলার

তবে তেলের দামে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। ওই বছর তেলের গড় দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, সর্বোচ্চ দাম ওঠে ১৩৯ ডলার। এতে বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের দামও বাড়তে থাকে। দেখা দেয় চড়া মূল্যস্ফীতি। তবে পরের বছরই এটি কমে ৮০ ডলারে আসে। ২০২৪ সালেও দাম ৭০ ডলারের ঘরে ছিল। আর এখন এটি নেমে এসেছে ৬০ ডলারের কাছাকাছি।

শিল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় মে মাসের সরবরাহ চুক্তিতে গত সপ্তাহে এলএনজির গড় দাম ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ ১৩ ডলার, যা গত ১১ অক্টোবরের পর সর্বনি¤œ। আগের সপ্তাহেও একই দামে পণ্যটি বেচাকেনা হয়েছে। ইন্টেলিজেন্স ফার্ম আইসিআইএসের সিনিয়র এলএনজি অ্যানালিস্ট অ্যালেক্স ফ্রোলি বলেন, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক ধীরগতির ঝুঁকি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শেয়ারবাজারের ধস ও সম্ভাব্য মন্দার শঙ্কায় জ্বালানির চাহিদাও কমতে পারে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। চীন শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্বের শীর্ষ এলএনজি আমদানিকারক দেশ চীন। ব্রেইনচাইল্ড কমোডিটি ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষক ক্লাস ডোজেমান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি চীনের জন্য সহায়ক নয়। এমনকি ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জন্যও এটি উদ্বেগের। বেশির ভাগ বিশ্লেষকই মনে করেন, এটি বৈশ্বিক বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ফলে এলএনজির চাহিদা আরো কমতে পারে।’

অ্যালেক্স ফ্রোলি জানান, এর আগেও ট্রাম্পের শুল্ক যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে এলএনজি প্রবাহে প্রভাব ফেলেছে। এমনকি ৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে চীনে কোনো মার্কিন এলএনজি কার্গো পৌঁছায়নি।

এদিকে ইউরোপের ডাচ ও ব্রিটিশ প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম শুক্রবার বিকালে তীব্র দরপতনের মুখোমুখি হয়। গত ছয় মাসের সর্বনি¤েœ নেমে যায় জ্বালানি পণ্যটির দাম। এ বিষয়ে আরগাসের হেড অব এলএনজি প্রাইসিং মার্টিন সিনিয়র বলেন, ‘যেসব হেজ ফান্ড (বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান) একসঙ্গে জ্বালানি ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল তারা বৃহস্পতিবার ঝুঁকি হ্রাসে ব্যাপকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করেছে। ফলে দাম কমেছে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এ দেশগুলো এরই মধ্যে ট্রাম্পের শুল্কের জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের পক্ষে মার্কিন এলএনজি আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ফলে এ পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের আশঙ্কা কম।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শুল্কের একটি পরোক্ষ প্রভাব হচ্ছে ডলারের মান কমে যাওয়া। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে মার্কিন এলএনজি অন্যান্য দেশের জন্য সস্তা হয়ে উঠতে পারে। ফলে মজুদ বাড়াতে ইউরোপে তা কেনার আগ্রহ বাড়বে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটস গত বৃহস্পতিবার মে মাসের সরবরাহ চুক্তিতে নর্থওয়েস্ট ইউরোপ এলএনজি মার্কার (এনডব্লিউএম) বাজার আদর্শে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম স্থির করেছে ১২ ডলার ৭ সেন্টে। এছাড়া একই মাসের সরবরাহ চুক্তিতে টিটিএফে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজিতে ৭৫ সেন্ট ছাড় দেয়া হয়েছে।

আরগাস প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির মূল্য নির্ধারণ করেছে ১২ ডলার ৭ সেন্ট। অন্যদিকে স্পার্ক কমোডিটিজ ডিসেম্বরে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম নির্ধারণ করেছে ১২ ডলার ৪ সেন্ট।

স্পার্ক কমোডিটিজের বিশ্লেষক কাসিম আফগান জানান, শুক্রবার আটলান্টিক মহাসাগরীয় পথে এলএনজির পরিবহন ব্যয় টানা দ্বিতীয় সপ্তাহের মতো কমে দৈনিক ২৩ হাজার ৫০০ ডলারে নেমে এসেছে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় পথে তা বেড়ে ২৬ হাজার ৭৫০ ডলারে পৌঁছেছে।

এদিকে তেলের দামে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। ওই বছর তেলের গড় দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, সর্বোচ্চ দাম ওঠে ১৩৯ ডলার। এতে বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের দামও বাড়তে থাকে। দেখা দেয় চড়া মূল্যস্ফীতি। তবে পরের বছরই এটি কমে ৮০ ডলারে আসে। ২০২৪ সালেও দাম ৭০ ডলারের ঘরে ছিল। আর এখন এটি নেমে এসেছে ৬০ ডলারের কাছাকাছি।

দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার পুরোটাই মেটানো হয় আমদানি থেকে। তাই চড়া দামে তেল আমদানি করার দায় এসে পড়ে ভোক্তার ওপর। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে বেশি চাহিদা ডিজেলের। কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন খাতে এ তেল ব্যবহৃত হয়। তাই এটির দাম বাড়লে পণ্যের দামও বেড়ে যায়, বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়।

দেশে ২০১৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর ডিজেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা। ২০২১ সালের নবেম্বরে দাম বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত এ দাম বহাল ছিল। একই সময়ে পেট্রল ৮৬ ও অকটেন বিক্রি হয়েছে ৮৯ টাকায়। যুদ্ধ শুরুর পর দেশেও দাম বাড়ানো হয়। ২০২২ সালের আগস্টে একলাফে ডিজেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১৪ টাকা। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ২৫ দিনের মাথায় দাম ৫ টাকা কমিয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় পেট্রল ১২৫ ও অকটেন ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

তবে গত বছরের মার্চ থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হয়। গত দুই মাস ধরে দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ হিসাবে বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫ টাকায় আর পেট্রল ১২২ ও অকটেন ১২৬ টাকায়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বিশ্ববাজারে দাম কমলেই সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব পড়ার সুযোগ নেই। তেল কেনার পর দেশে আসতে এক মাস লেগে যায়। তাই স্বয়ংক্রিয় মূল্য প্রক্রিয়ায় আগের মাসের আমদানি খরচ ধরে মূল্য সমন্বয় করা হয়। তেলের দাম নির্ধারণে ডলারের দাম বড় সূচক হিসেবে কাজ করে।

বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, দাম এখনকার মতো কম থাকলে আগামী মাসের সমন্বয়ে প্রভাব পড়বে। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চার বছর আগের দামে ফেরা সম্ভব হবে না। বিপিসির অস্বাভাবিক মুনাফা করার কোনো সুযোগ নেই; বরং তেলের দাম ভোক্তার জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করে বিপিসি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৫ থেকে ১০৫ টাকা। বর্তমানে এটি বেড়ে হয়েছে ১২২ টাকা। এর মানে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে এখন ১৭ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে ডলার কিনতে। এতে বিপিসির খরচ বেড়েছে।

দেশে দুই ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় পরিশোধিত ও অপরিশোধিত। যদিও সক্ষমতা না থাকায় কম দামের সময় বেশি হারে অপরিশোধিত তেল আমদানি করা যায় না। সক্ষমতার ক্ষেত্রে দুই ধরনের ঘাটতি আছে। একটি হলো পরিশোধনাগারের অভাব ও দ্বিতীয়টি মজুতের সক্ষমতা। বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। আবার এক মাসের চাহিদার সমপরিমাণ মজুতের সক্ষমতা থাকায় বাড়তি পরিশোধিত জ্বালানিও আমদানির সুযোগ নেই।

বছরে ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল। একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া যায় ছয় লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়। ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েলের দাম কমলে ডিজেলের দামও কমে যায়। গত এক সপ্তাহে ডিজেলের দামও কমেছে ৬ থেকে ৭ ডলার। এতে আমদানি খরচ কমবে বিপিসির।

একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে তেল আমদানি করে বিপিসি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল হিসেবে ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েল আমদানি করে না তারা। মূলত সৌদি আরব থেকে অ্যারাবিয়ান লাইট ও আরব আমিরাত থেকে মারবান লাইট আমদানি করে বাংলাদেশ। ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েলের চেয়ে এ দুটি তেলের দাম সাধারণত এক থেকে দেড় ডলার বেশি।

বিপিসি ও ইআরএল (ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড) সূত্র বলছে, দেশে পরিশোধন করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৫ টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব। দেশে প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করতে হলে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হবে। দ্বিগুণ সক্ষমতার নতুন শোধনাগারটি নির্মাণ করা গেলে মজুত সক্ষমতাও বাড়বে। কম দামের সময় বাড়তি আমদানি করে জ্বালানি তেল মজুত করতে পারবে বাংলাদেশ।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে বেশি থাকবে। দৈনিক চাহিদার চেয়ে ৬ লাখ ব্যারেল তেল বেশি সরবরাহ থাকবে বলে তাদের পূর্বাভাস। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও অবশ্য আগে সে রকম আভাস দিয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও অন্যদিকে চীনের চাহিদা কম থাকায় সরবরাহ বাড়বে। ফলে এ বছর তেলের দাম তেমন একটা বাড়বে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। পূর্বাভাস বলছে, আগামী নবেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই কমতে থাকবে তেলের দাম। এরপর কিছুটা বাড়তে পারে।