সৈয়দপুর (নীলফামারী) সংবাদদাতা : নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বিশ্বের সর্বপ্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল (গোদ রোগ চিকিৎসা কেন্দ্র) দীর্ঘ তিন বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বিশেষায়িত এই স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানটি এখন অযতেœ ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। শুধুমাত্র দূর্নীতির গ্যাড়াকলে পড়ে বিশ্বমানের এই প্রতিষ্ঠানটির এমন করুন দশা।
সরেজমিন শনিবার (১৫ নভেম্বর) সকালে গেলে উত্তরের জেলা নীলফামারীসহ ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ফাইলেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগের চিকিৎসার জন্য ২০০২ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ এলাকায় ৭৫ শতক জায়গায় যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইম্যুনোলজি অব বাংলাদেশ (আইএসিআইবি) হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিল। তৎকালীন এমপি ও পৌর মেয়র বিএনপি নেতা আমজাদ হোসেন সরকারের মধ্যস্থতায় স্থানীয় কবির সরদার জমি দান করায় এটি স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।
হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রকল্প পরিচালক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন ওই সময় স্থানীয়ভাবে ১৮ জন দেশি-বিদেশি চিকিৎসককে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। জাপান, কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় দুটি বহুতল ভবন নিয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকেও গবেষণা কর্মীরা আসেন এখানে।
তবে ২০১২ সালে হাসপাতালটিকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে সংকট সৃষ্টি হয়। পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বে ভেঙ্গে পড়ে সেবা কার্যক্রম। মুখ ফিরিয়ে নেয় দাতা সংস্থাগুলো। এরপর কিছু দিন ধুঁকে ধুঁকে চলে একসময় বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালটি। সর্বশেষ বাংলাদেশ প্যারামেডিকেল এসোসিয়েশন (বিপিডিএ) হেলথ এডুকেশন ট্রেনিং এন্ড টেকনোলজি লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাসপাতালটি পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু তাদের দূর্নীতির কারণে আজ এটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ।
বিপিডিএ ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর থেকে দায়িত্ব নেয় এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে টোকেন মূল্যে চিকিৎসা দেয়ার প্রত্যয়ে সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাব নামে নতুন কার্যক্রম শুরু করে। এরপর বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন করে প্রায় ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়।
এর আগে ২০১১ সালে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন হাসপাতালটি বন্ধ করে সাভারের হাসপাতালটি জমজমাট করার জন্য হাসপাতালের ৬৯.৫০ শতক জমির মধ্যে ২৯.৫০ শতক জমি বিক্রি করে দেন। বাকি জমিসহ হাসপাতালটি বিক্রির জন্য পরবর্তী সময়ে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালান। এতে ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে বিপিডিএ এর মহাসচিব রাকিবুল ইসলাম তুহিন। সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া হাসপাতালের সাবেক উপদেষ্টা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সাধারণ সম্পাদক ডা. শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটিকে মূলত: রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ধ্বংস করা হয়েছে। তৎকালীন নীলফামারী-৪ আসনের এমপি জাতীয় পার্টি নেতা আহসান আদেলুর রহমান আদেলের কারণে স্থানীয় জাপা নেতা পল্লী চিকিৎসক সুরত আলী প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে হাসপাতালটি কুক্ষিগত করে। তার মাধ্যমে ব্যাপক দূর্নীতি করে জমজমাট হাসপাতালের সব লুটপাট করা হয়। এরপর যারাই হাসপাতালটি পরিচালনা করেন সবাই সেবার বদলে বাণিজ্য করেছেন। আমরা চাই আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালটি দ্রুত চালু করে অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার
করা হোক।
পল্লী চিকিৎিসক সুরত আলী মারা যাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ আহমেদ ও ইউপি চেয়ারম্যান জিকো আহমেদ নিজেদের মত করে পরিচালনা কমিটি করে হাসপাতাল চালায়। এসময় প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে জামানত হিসেবে ৩০ হাজার থেকে ৫ লাখ এবং সমপরিমান এককালীন উন্নয়ন ফি (অফেরতযোগ্য) সহ পদ অনুযায়ী নিম্নে ৫০ হাজার থেকে ৮ লাখ করে অর্থ নেয়া হয়েছে। কিন্তু নিয়োগের পর মাত্র ২-৩ মাস বেতন দেয়ার পর থেকে দীর্ঘ ১০-১৫ মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া সকলের।
এতে বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়েও কেউ জামানত ও উন্নয়ন ফির টাকা ফেরত পায়নি আজও। এমনকি গত প্রায় ৩ বছর ধরে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেলেও কোন সুরাহা মেলেনি। বরং উল্টো পরবর্তীতে জমা দেয়া নিজেদের স্বাক্ষরকৃত ফাঁকা (ব্লাংক) ব্যাংক চেক নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বিপিডিএ সদস্য সচিব ডা. রাকিবুল ইসলাম তুহিন দায়িত্ব নেয়ার পর নিয়োগকৃতদের কাছ থেকে এই চেক নিয়েছেন।
আয়া পদে চাকরি করা মায়া বেগম, রেজিনা বেগম, দুলালী বলেন, আমরা মূলত: স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ আহমেদ পরিচালক হওয়ায় তাকে বিশ্বাস করে নিয়োগের সময় তাকে ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছি। তিনি পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেও সেই টাকা আজও ফেরত পাইনি। তারপর ডা. তুহিন পরিচালক হয়ে ওই টাকা দেয়াতো দূরের কথা বরং চাকরি করতে হলে ফাঁকা চেক দিতে হবে বলে চাপ দেয়। আমরা গরীব মানুষ। পেটের দায়ে কাজ করার সুযোগ পেতে বাধ্য হয়ে তিনটা করে ব্যাংক চেক স্বাক্ষর করে দিয়েছি। এখন চাকরি নাই। তবুও টাকা, চেক ও বকেয়া বেতন কিছুই ফেরত দেয়নি ফয়েজ ও তুহিন। অথচ অসংখ্য বার ধর্ণা দিয়েছি।
জমিদাতা কবির সরদারের ছেলে ঢাকার গার্মেন্টস শিল্প মালিক বাবুল হোসেন বলেন, মূলত: ফয়েজ ও তুহিন আমাদেরকে বোকা বানিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা ডা. মোয়াজ্জেমের হয়ে ষড়যন্ত্র করে ফাইলেরিয়া হাসপাতালটিকে ধ্বংস করেছে। আমি পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি থাকাকালে তাদের দূর্নীতি আঁচ করে প্রতিবাদ করায় বহিরাগত লোকজনকে দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে। যার প্রেক্ষিতে সংবাদ কর্মীদের সাথে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জেরে হাসপাতাল সীলগালা করে দিয়েছে সিভিল সার্জন।
এ ব্যাপারে সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও ফাইলেরিয়া হাসপাতালের সাবেক কো-অর্ডিনেটর ফয়েজ আহমেদ বলেন, আমাকেও এক প্রকার জোর করেই কৌশলে বের করে দেয়া হয়েছে। আমরা যখন দায়িত্ব নেই তখন হাসপাতালে কিছুই ছিলনা। ডা. মোয়াজ্জেম সব মেশিনপত্র আগেই নিয়ে গেছেন। লোকবল নিয়োগ দিয়ে যে টাকা নেয়া হয়েছে তা দিয়ে মাত্র দুই একটা মেশিন কেনা সম্ভব হয়েছে। আমি নিজের জমি বিক্রি করে ৫৬ লাখ টাকা দিয়ে আধুনিক মেশিন কিনেছি। আমাকে বিদায় দেয়ার আগে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট দিয়ে অডিট করে সব বুঝে নিয়েছে ডা. রাকিবুল ইসলাম তুহিন ও বাবুল হোসেন গং। নিয়োগ বাণিজ্যে অর্থ হাতানো দূরে থাক বরং আমিই এখন টাকা পাবো।
হাসপাতালের সর্বশেষ পরিচালকের দায়িত্বে থাকা বিপিডিএ সদস্য সচিব রাকিবুল ইসলাম তুহিন বলেন, হাসপাতালসহ জমি বিক্রি করা ও মেশিনপত্র নিয়ে যাওয়ায় ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন স্যারের বিরুদ্ধে মামলা করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তার কিছু এজেন্টের মাধ্যমে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ভুল বুঝিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তখন কিছু দুই টাকার সাংবাদিকের অপতৎপরতায় ফাইলেরিয়া সীলগালা করা হয়েছে। আমি কোন দূর্নীতি করিনি। কারণ নিয়োগ দিয়ে টাকা আমি নেইনি। ব্লাংক চেক কি আপনি নিতে পারেন? জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, সেটা আপনার বিষয় নয়। যথাযথ অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখবে। আপনারাই (সংবাদ কর্মী) প্রতিষ্ঠানটা বন্ধ করে দিয়েছেন।
এদিকে একটা সূত্র মতে, ডা. মোয়াজ্জেম হাসপাতালটি চালু করতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন। সৈয়দপুরের একজন উদ্যোক্তাসহ কয়েকজন মিলে এটা পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর প্রেক্ষিতে ৯৫ লাখ টাকা দাবি করেছেন ডা. মোয়াজ্জেম। গত বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) তিনি তার স্থানীয় প্রতিনিধি তোতা নামে এক ব্যক্তিকে সৈয়দপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শামসুন্নাহার বেগমের কাছে পাঠিয়ে হাসপাতালে লাগানো সিভিল সার্জন কর্তৃক সীলমোহরকৃত তালার চাবি চেয়েছেন।
এর আগে তিনি সরকারি একটা প্রজ্ঞাপনের আলোকে ওই চাবি পেতে এবং ফাইলেরিয়া হাসপাতাল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়ার আবেদনও করেছেন। সূত্রের অভিযোগ কিছু দিন হলো ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে দুূদকে মামলা হয়েছে এবং তদন্ত শুরু হয়েছে। একারণে তিনি সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি চালু দেখাতে এই তৎপরতা শুরু করেছেন। মূলত: তিনি হাসপাতালটি বিক্রি করে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। নীলফামারী জেলা সিভিল সার্জন আব্দুর রাজ্জাক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের আবেদন পাওয়ার বিষয় স্বীকার করে বলেন, সরকারি ওই প্রজ্ঞাপন মূলত: চালু থাকা স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। এক্ষেত্রে বন্ধ থাকা বা অনিয়ম দূর্নীতির কারণে সরকারিভাবে জব্দকৃত প্রতিষ্ঠান এই প্রজ্ঞাপনের আওতায় পড়েনা। ফাইলেরিয়া হাসপাতাল চালু বিষয়ে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত নেই। মালিকানা নিয়ে জটিলতা নিরসন করে উভয় পক্ষের সম্মতিতে বা আদালত কর্তৃক দেয়া আদেশের প্রেক্ষিতে চালুর সিদ্ধান্ত হলেই কেবল সীলমোহর করা তালার চাবি হস্তান্তর করা হবে। এর আগে কোনোভাবেই কোন পক্ষকে এটা দেয়া হবে না।
ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে এব্যাপারে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান ভালো চলুক এটা আমি সবসময়ই চাই। তাই চেষ্টা করি সচল রাখতে। কিন্তু ওই এলাকার কুচক্রী মহল আমাকেই দোষারোপ করে। অথচ তাদের কারণেই আজ হাসপাতালটি বন্ধ। ভালো কেউ উদ্যোগ নিলে তাদের সহযোগিতা করা উচিত তাই তৎপরতা চলছে। এতে কি সমস্যা। বিনিময়ে টাকা নিচ্ছেন কেন? জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে বার বার কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলার বিষয়েও কোন মন্তব্য জানা
সম্ভব হয়নি।