পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগ করতে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া মার্জিন ঋণ সুবিধা বা অর্থায়নের বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। নতুন গেজেট অনুযায়ী মার্জিন ঋণ ব্যবস্থা কিছুটা জটিল ও শর্তে ঘেরা প্রক্রিয়ার মধ্যে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, এখন আর কেউ নিজ মূলধনের বেশি পরিমাণ মার্জিন ঋণ সুবিধা নিতে পারবে না। আর মার্জিন ঋণের পোর্টফোলিও ৭৫ শতাংশের নিচে নামলেই ঋণগ্রহীতাকে তলব (মার্জিন কল) করা হবে। কোনোভাবে পোর্টফোলিও ৫০ শতাংশের নিচে নামলেই ‘মার্জিন অর্থায়নকারী’ বিনা নোটিশে ঋণগ্রহীতার পোর্টফোলিও হিসাবে রক্ষিত প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিকিউরিটিজ (শেয়ার ও ইউনিট) বাধ্যতামূলকভাবে বিক্রি করে (ফোর্স সেল) মার্জিন ঋণ তুলে নিতে পারবে।

‘মার্জিন (রুলস) রুলস, ২০২৫’ ও ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (মার্জিন) বিধিমালা, ২০২৫’ গত নভেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই বিধিমালায় মার্জিন ঋণ নিয়ে এমন নিয়ম করা হয়েছে। তবে পুরাতন বিধিমালার (১৯৯৯ সালের মার্জিন বিধিমালা) অধীনে যেসব মার্জিন ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সেই বিধিমালার আলোকেই নিষ্পত্তি করা হবে।

নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, একজন বিনিয়োগকারী তার নিজস্ব মূলধনের বেশি ঋণ সুবিধা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ গ্রাহককে তার ইক্যুইটির বেশি মার্জিন ঋণ দেওয়া যাবে না। গ্রাহকের ন্যূনতম ইক্যুইটি পাঁচ লাখ টাকা হতে হবে এবং গত এক বছরে পুঁজিবাজারে গড়ে এই পরিমাণ বিনিয়োগ থাকতে হবে। একজন সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত মার্জিন ঋণ পাবেন, তবে তা ঋণদাতার প্রকৃত মূলধন বা নিট সম্পদ মূল্যের ১৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।

যেসব বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজারে পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ রয়েছে, তারা মার্জিন সুবিধা পাবেন না। যাদের বিনিয়োগ পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে, তারা মার্জিন অনুপাতে সর্বোচ্চ ইক্যুইটি মূলধনের অর্ধেক পরিমাণ মার্জিন ঋণ সুবিধা নিতে পারবে। আর যাদের বিনিয়োগ ১০ লাখ টাকার বেশি, তারা তাদের ইক্যুইটির সমপরিমাণ মার্জিন ঋণ নিতে পারবে। এ ছাড়া লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করার ক্ষেত্রে ইক্যুইটি ও মার্জিন অর্থায়ন অনুপাত হবে ১:০.২৫। অর্থাৎ এই শেয়ারের বিনিয়োগকারী প্রতি ১০০ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ২৫ টাকা হারে মার্জিন ঋণ নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে শর্ত হলো– মার্জিন ঋণ পেতে হলে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর অ্যাকচুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন স্টক এক্সচেঞ্জ ও কোম্পানি নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে।

এদিকে বাজারের সার্বিক মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) যদি ২০-এর বেশি হয়, তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জকে অনতিবিলম্বে ওয়েবসাইটে সতর্কতা জারি করতে হবে। এক্ষেত্রে মার্জিন অর্থায়ন গ্রাহকের ইক্যুইটি মূলধনের অর্ধেকের বেশি হতে পারবে না। অর্থাৎ, ১০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলেও নিজস্ব পোর্টফোলিও ইক্যুইটি মূলধনের অর্ধেকের বেশি মার্জিন ঋণ নেওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিধিমালায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, কোনো ছাত্রছাত্রী, গৃহিণী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি মার্জিন লোন নিতে পারবেন না, তবে অর্থসচ্ছল অবসরপ্রাপ্ত বিনিয়োগকারীরা এই সুবিধা পাবেন। শুধু ‘এ’ ক্যাটাগরি এবং কমপক্ষে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদানকারী ‘বি’ ক্যাটাগরির শেয়ারে ঋণ পাওয়া যাবে। আবার ইতোমধ্যে কেনা শেয়ারের বাজার মূল্য বৃদ্ধি বিবেচনায় নতুন ঋণ মিলবে না। আরও ঋণ চাইলে আগে শেয়ার বিক্রি করে নগদায়ন করতে হবে।

এদিকে ঋণগ্রহীতার পোর্টফোলিওতে নিজস্ব বিনিয়োগ মূল্য ৭৫ শতাংশে নামলেই ওই বিনিয়োগকারীকে ‘মার্জিন তলব’ করবে ঋণদাতা। এক্ষেত্রে ঋণদাতার পরামর্শ সাপেক্ষে তার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে ঋণ অনুপাত সমন্বয় করা যাবে। তবে ঋণগ্রহীতার পোর্টফোলিওতে নিজস্ব বিনিয়োগ মূল্য ৫০ শতাংশের নিচে নামলেই তাকে কোনো প্রকার নোটিশ না দিয়েই ‘ফোর্স সেল’ বা বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি করা যাবে। আবার মার্জিন ঋণের বিপরীতে প্রতি তিন মাসে নগদে বা শেয়ার বিক্রি করে সুদ দিতে হবে। অন্যথায় ঋণদাতা শেয়ার বিক্রি করে সুদ আদায় করতে পারবে। মার্জিন অ্যাকাউন্ট খুলতে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আগে মার্জিন ঋণ নিয়ে থাকলে তার ঘোষণা দিতে হবে। এক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ বা অসত্য তথ্য দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

মার্জিন অ্যাকাউন্ট হবে সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদি। মেয়াদ শেষে নবায়ন না করে চালানো যাবে না। নবায়ন না হলে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করে সমন্বয় করা হবে। চেক বা পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট দিয়ে মার্জিন ঋণসহ শেয়ার কেনার পরদিনও তা নগদায়ন না হলে ঋণদাতা শেয়ার বিক্রি করে সমন্বয় করবে। এক্ষেত্রে লাভ বা ক্ষতি যাই হবে তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। বিধিমালার কারণে যেসব শেয়ার ঋণযোগ্য হবে না, সেগুলো বিক্রি করতেও ছয় মাস থেকে এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে। নতুন বিধিমালা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে পরিবর্তনগুলো মানিয়ে নিতে সহনীয় সময় পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, মার্জিন ঋণ বিধিমালায় পুরোনোদের জন্য ৬ মাস সময় দেওয়া হয়েছে। নতুন যারা মার্জিন ঋণ নেবে তাদের জন্য কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ, মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আস্তে আস্তে মার্জিন ঋণের ঝুঁকি থেকে বিনিয়োগকারীদের সরিয়ে আনতে নতুন বিধিমালা করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে এর সুফল আসবে।