ড. মোহাম্মদ নাকিবুর রহমান
আজ আমার আব্বুর শাহাদাতের ৯ম বার্ষিকী। ঠিক নয় বছর আগে, ১১ই মে, খুনি শেখ হাসিনা বিচারিক প্রক্রিয়ায় আমার আব্বুকে হত্যা করে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আব্বুকে শহীদের মর্যাদা দেন, তাঁর সকল গুনাহ মাফ করে দেন এবং আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে অটল রাখেন -যাতে জান্নাতে আমরা আব্বুর সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে পারি।
এত বছর পরেও, আমি এখনো আব্বুর সঙ্গে কাটানো মধুর কিছু মুহূর্ত স্মরণ করি। কিছুটা ঝাপসা, কিছুটা একেবারে স্পষ্ট। ওটাই আমার সুখের জায়গা। আমি চোখ বন্ধ করি, চেয়ারে হেলান দেই, স্মৃতির পথে হাঁটি আর অশ্রু আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ে। কেউ সেটা আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।
আমার সবচেয়ে পুরোন স্মৃতি সম্ভবত ১৯৮৪ সালে, তখন আমার বয়স সাত বছরের মতো ছিলো। আমরা তখন এক ভাড়াবাড়িতে থাকতাম আজিমপুরের ৩০ শাহ সাব বাড়ি লেন। ঠিকানা এখনো পরিষ্কার মনে আছে। ছোট একটা দুই বেডরুমের ফ্ল্যাট, একটা লিভিং রুম, একটাই বাথরুম। কিন্তু সবচেয়ে ভালো ছিল দুটি লম্বা বারান্দা। বাবা-মা একটি রুমে থাকতেন, আর আমরা পাঁচ ভাইবোন (সবার ছোট ভাই তখনও জন্মায়নি) অন্য রুমটা ভাগ করে নিতাম। চাপাচাপি গাদাগাদি ছিল, কিন্তু খুব মজার, আনন্দে ভরা স্মৃতি।
সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত হতো, যখন আব্বু দীর্ঘ কর্মদিবস শেষে বা সংগঠনের সফর থেকে বাড়ি ফিরতেন। আমরা চার ভাইবোন দৌঁড়ে গিয়ে আব্বুর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। বড় আপু দায়িত্ব নিয়ে আব্বুর ব্যাগ নিতো, মোমেন আর খালেদ (যারা যমজ) বলতো, “আব্বু আসছে, কোলে উঠাও, গলা ধরো!”, আর আমি সব সময় আব্বুর জুতো খুলে মোজা সরানোর দায়িত্ব নিতাম। মনে হয়, আমি ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এই কাজ করেছি, যতদিন না উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাই।
আব্বু মোজা-জুতো নিয়ে খুব নিখুঁত ছিলেন বাঁ পায়ের মোজা বাঁ জুতায়, ডান পায়ের মোজা ডান জুতায় রাখা পছন্দ করতেন। ভুল করলে একটু হতাশ হতেন। কিন্তু বড় হতে হতে এই ছোট কাজটিই হয়ে উঠেছিল আমাদের কথাবার্তার একটা প্রিয় সময়। এখনো সেটা গভীরভাবে স্মরণ করি।
আব্বু অনেক ব্যস্ত থাকলেও, মাঝে মাঝে আমাদের (আমি, মোমেন, খালেদ) নিয়ে আজিমপুর কলোনির মাঠে ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতেন। কখনো ড. আমিনুল ইসলাম (মুকুল ভাই), তাঁর ভাই আজিজ ভাই, হেমায়েত চাচা -এরা যোগ দিতেন। আব্বু না থাকলে হেমায়েত চাচা আমাদের নিয়ে যেতেন।
আব্বু খেলাধুলার বড় ভক্ত ছিলেন- বিশেষ করে আর্জেন্টিনা আর দিয়াগো ম্যারাডোনার। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের সময় ( মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত), আমাদের বাড়িতে টিভি ছিল না। তখন আমরা মগবাজারে নতুন একটা ভাড়াবাড়িতে উঠেছি। রাতের বেলা খেলা হতো, তাই কোথাও যেতে পারতাম না। আম্মু যেতে দিতেন না। কিন্তু আব্বুই উদ্ধার করলেন- আমাকে নিয়ে গেলেন দৈনিক সংগ্রাম অফিসে, সম্পাদক আবুল আসাদ চাচার রুমে। সেখানে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভিতে আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানির ফাইনাল খেলা দেখলাম অনেকের সঙ্গে। আমি ছিলাম ডাচ ভক্ত। কিন্তু সেই রাতেই আব্বু আমার নায়ক হয়ে উঠলেন আমার আবেগ বোঝার জন্য।

আব্বুর communication ধরণ ছিল অনন্য। কোনো কিছুতে সরাসরি “না” বলতেন না। বলতেন, “না গেলেই ভালো হতো।” আমরা বুঝে যেতাম। কখনো কিছু করতে বাধ্য করতেন না। আমি যখন ১৭ বছর বয়সে দাড়ি কামাতে শুরু করি, আব্বু সেটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু বলতেন না কিছু। একদিন শুধু বললেন, “ তোমার মুখ থেকে নিষ্পাপ ভাবটা চলে যাচ্ছে দাড়ি কামানোর পর থেকে।” বুঝেছিলাম কিন্তু অবহেলা করেছিলাম। এখন মনে হয়, সময়ে ফিরে যেতে পারলে ঠিক করতাম আব্বু অনেক খুশি হতেন।
আব্বু আমাদের সবার কাছ থেকে সেরা কিছু আশা করতেন। আমরা সব সময় সেটা পূরণ করতে পারতাম না। সাফল্যে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতেন না। তিনি চেয়েছিলেন আমরা নম্র থাকি। ২০০৫–২০০৬ সালে আমি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম। আমার এক ছাত্রী, তৎকালীন পরিকল্পনা সচিবের মেয়ে, এক বিয়েতে আব্বুর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল আমি তার শিক্ষক। আব্বু বলেছিলেন, “ও কী কিছু পড়াতে পারে?-”সবিনয়ে। মেয়েটি হেসেছিল, পরে আমায় বলেছিল। এটাই ছিল আব্বু -নিরহংকার, আমাদের বিনয়ী রাখতেন, কিন্তু হৃদয় দিয়ে দোয়া করতেন।

বিদেশে আব্বুর সঙ্গে একবারই যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল-তা-ও এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে অনার্স শেষ করে বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। তখন আব্বুর দুই চোখেই ছানি ধরা পড়ে। বাম চোখে অপারেশন হওয়ার কথা। ডা. হারুন বলেছিলেন, জটিল কিছু না। এক লাখে হয়তো একজনেরই ইনফেকশন হয়। কিন্তু অপারেশনের পর আব্বু অসুবিধা অনুভব করলেন। পরে জানা গেল, ইনফেকশন হয়েছে। aggressive infection । চিকিৎসার জন্য চোখে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেয়া অ্যান্টিবায়োটিক-আব্বুর রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত করলো।
আমি তখন আব্বুর ব্যক্তিগত নার্স হয়ে যাই। প্রতি ৩০ মিনিট পরপর চোখে ড্রপ দিতাম। পরে রেটিনা স্পেশালিস্ট ডা. নিয়াজ বললেন, এটা ম্যাকুলার ডিজেনারেশন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানোর সম্ভাবনা। জামায়াত সিদ্ধান্ত নেয় আব্বুকে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে হবে। আমাকেও সাথে পাঠানো হলো।
ফ্লাইটটা অন্যরকম ছিল। আব্বু ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, কিন্তু সব সময় দোয়া আর জিকির করছিলেন। পরদিন ডা. আর্থার লিম পরীক্ষা করে বললেন- আব্বু বাম চোখে আর কখনো দেখবেন না। ডান চোখে এখনো ভালো, তাড়াতাড়ি অপারেশন দরকার।
আমি ভেঙে পড়লাম। এতক্ষণ শক্ত ছিলাম, কিন্তু সহ্য করতে পারলাম না। আব্বু শান্ত করলেন, বললেন, “মনে করেছিলাম তুমি বড় হয়েছো, কিন্তু মনে হচ্ছে ভুল করেছি তোমাকে এনে।” সে রাতেই তাহাজ্জুদের সময় আমাকে ডাকলেন, বললেন
“অশ্রু অনেক দামী জিনিস। অপচয় করো না। অশ্রু জমাও, শুধুই আল্লাহর সামনে অশ্রু ফেলো।”
আমি চেষ্টা করি সেই উপদেশে জীবন চালাতে। কিন্তু দুর্বল মন মাঝে মাঝে হার মানে। বহুদিন পর্যন্ত বিমানবন্দরে বসে থাকতে পারতাম না। চোখের সামনে ভেসে উঠতো- আব্বু পাশে বসে চুপচাপ- জিকির করছেন আর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।
যখন আমি ৭-৮ বছরের, আব্বু দুপুরে বিশ্রাম নেয়ার সময় কুরআনের কাহিনি ও ইসলামি ইতিহাস বলতেন। আমরা চার ভাইবোন তাঁকে ঘিরে বসতাম। ইব্রাহিম (আ.), ইউসুফ (আ.), মূসা (আ.) সহ আরও অনেকের গল্প বলতেন অনুপ্রেরণামূলকভাবে। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গল্প ছিল সূরা ইয়াসিনে উল্লিখিত সেই ব্যক্তির -যদি শহরের এক প্রান্ত থেকে এসে সেখানকার রাসূলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রতিবার সূরা ইয়াসিন পড়লে আমার চোখে পানি চলে আসে।
আমি দোয়া করি: হে আল্লাহ, আমার আব্বুকে তেমনই জান্নাতে প্রবেশ করাও, যেমন তুমি সেই মানুষটিকে করেছো, যাকে শুধু তোমার প্রতি বিশ্বাসের জন্য তাঁর জাতি হত্যা করেছিল।
তাকে বলা হলো: “তুমি জান্নাতে প্রবেশ করো।”
সে বলল,হায় ,যদি আমার জাতি জানত-
সে আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।” সূরা ইয়াসিন: ২৬-২৭।
লেখক : শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর জেষ্ঠ সন্তান ও সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা, যুক্তরাষ্ট্র।