গত বছর জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। তবে ইতিহাসে তিনি একমাত্র ক্ষমতাচ্যুত নেতা নন—বিশ্বের নানা দেশে বহু রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমতা হারিয়ে আদালতের মুখোমুখি হয়েছেন।

নীচে বিচার কিংবা পরিণতির মুখোমুখি হওয়া কিছু শাসকের ঘটনা তুলে ধরা হলো:

নিকোলাই চচেস্কু

ষাটের দশকে ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত প্রভাবের অধীনে থাকলেও রোমানিয়ার নেতা নিকোলাই চচেস্কু মস্কোর আধিপত্যে না বলেছিলেন। শুরুতে তিনি সংস্কারপন্থী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেও অল্প সময়ের মধ্যেই রূপ নেন নির্মম স্বৈরশাসকে।

১৯৭১ সালে চীন ও উত্তর কোরিয়া সফরের পর তিনি কিম ইল সুং ও মাও সেতুং–এর মতো পূর্ণ ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণ ও ব্যক্তিপূজার রাজনীতি চালু করেন। গোয়েন্দা সংস্থা সিকিউরিটেট দেশের প্রতিটি ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। ফোন, চিঠি, এমনকি রোগীর চিকিৎসা ও শিশুদের কথা—সবকিছু নজরদারিতে রাখা হতো।

অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থ উন্নয়ন প্রকল্প দেশজুড়ে তীব্র খাদ্য ও জ্বালানি সংকট সৃষ্টি করে। এরই মধ্যে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে টিমিসোয়ারায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশি নিপীড়নে তা আরও তীব্র হয়। জনগণের প্রতি গুলি চালাতে সেনারা অস্বীকৃতি জানালে বিক্ষোভ দ্রুত রাজধানী বুখারেস্টে ছড়িয়ে পড়ে।

২২ ডিসেম্বর জনতার চাপে সেনাবাহিনী চচেস্কুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পালানোর চেষ্টা করেও তিনি ও তাঁর স্ত্রী এলেনা ধরা পড়েন।

২৫ ডিসেম্বর বুখারেস্টের এক সামরিক ঘাঁটিতে তড়িঘড়ি গড়া সামরিক আদালতে চচেস্কু দম্পতির বিরুদ্ধে গণহত্যা, অর্থনীতি ধ্বংস ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের অভিযোগ আনা হয়। বিচার–প্রক্রিয়া মাত্র দুই ঘণ্টায় শেষ হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেনারা ক্যামেরার অপেক্ষা না করে গুলি চালিয়ে রায় কার্যকর করে। পরবর্তীতে তাদের গুলিবিদ্ধ দেহ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়।

পশ্চিমা বিশ্ব এই বিচারকে তড়িঘড়ি ও অস্বচ্ছ হিসেবে সমালোচনা করলেও রোমানিয়ার সাধারণ মানুষ একে দীর্ঘদিনের দমন–পীড়নের প্রতিশোধ হিসেবে ন্যায্য মনে করেন।

সাদ্দাম হোসেন

ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের সময় অপসারণ করা হয় এবং কয়েক মাস পর তাঁকে মার্কিন বাহিনী গ্রেপ্তার করে।

বাগদাদের বিশেষ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালে দুজাইলে ১৪৮ জন শিয়াকে হত্যার অভিযোগে বিচার শুরু হয়। নয় মাসের বিচার শেষে ২০০৬ সালের ৫ নভেম্বর সাদ্দামকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি আপিল করলেও সেটি খারিজ হয়। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

হোসনি মোবারক

মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ৩০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আরব বসন্তের সময় জনরোষে ক্ষমতাচ্যুত হন।

তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ, ব্যাপক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটসহ নানা অভিযোগ আনা হলেও দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে তিনি বেশিরভাগ অভিযোগে খালাস পান। ছোট একটি দুর্নীতি মামলায় মাত্র সাজা হয়েছিল।

মোবারক ছিলেন প্রথম আরব নেতা যিনি নিজ দেশের আদালতে সরাসরি বিচারের মুখোমুখি হন।

হিসেন হাব্রে

আফ্রিকার চাদ রাষ্ট্রের স্বৈরশাসক হিসেন হাব্রের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয় সেনেগালে প্রতিষ্ঠিত এক্সট্রাঅর্ডিনারি আফ্রিকান চেম্বারস–এ। ২০১৫ সালে বিচার শুরু হয়ে ২০১7 সালে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন আফ্রিকার প্রথম সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান যাকে অন্য আফ্রিকান দেশের আদালত দোষী সাব্যস্ত করে।

যারা পালিয়ে গিয়ে শাস্তি এড়ান

অনেক শাসক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও কেউ কেউ দেশ ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন এবং এখনো নির্বাসনে জীবন কাটাচ্ছেন।

ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ – ইউক্রেন

রাশিয়াপন্থি নীতির কারণে ২০১৪ সালে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই রয়েছেন।

বাশার আল–আসাদ – সিরিয়া

দুই যুগ ক্ষমতায় থাকা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার সমর্থন টিকিয়ে রেখেছিল। তবে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বিদ্রোহীরা তাঁর শাসন শেষ করে দেয় বলে খবর দেওয়া হয়, এবং পরে তিনি রাশিয়ায় আশ্রয় নেন বলে দাবি করে রুশ গণমাধ্যম।