সোমালিয়া উপকূল এবং আরব সাগরের বিস্তৃত জলপথে জলদস্যুরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে তাদেরকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে গত দেড় বছরে ভারতীয় নৌবাহিনী একের পর এক নজির গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই রুটে প্রতিদিন হাজার হাজার কন্টেইনার জাহাজ চলাচল করে। ফলে এই রুটে ভারতীয় নৌবাহিনীর উপস্থিতি শুধু দেশীয় নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখছে।
‘এমভি রুয়েন’ মাল্টার–পতাকাবাহী বাল্ক ক্যারিয়ার ২০২৩ সালের ডিসেম্বর সোমালিয়া উপকূলে অপহৃত হয়। ২০২৪ এর মার্চে আরব সাগরে সেটিকে চিহ্নিত করে ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার আইএনএস কলকাতা। প্রায় ৪০ ঘণ্টার কৌশলগত চাপ ও অপারেশনের পর ১৭ জন নাবিককে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। ৩৫ জন জলদস্যুকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, এই অভিযান ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর সাম্প্রতিক কালের অন্যতম সেরা সমুদ্র–অপারেশন। কারণ এটি শুধু অপহৃত জাহাজকে মুক্তই করেনি বরং জলদস্যুদের সরাসরি আইনের আওতায় এনেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে লিবিয়ার পতাকাবাহী ‘এমভি লিলা নরফোক’ জাহাজে ২১ জন নাবিক আটকা পড়েছিলেন, যাদের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন ভারতীয়। হাইজ্যাকের খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ভারতীয় নৌ-কমান্ডাররা। অভিযানের পর সবাইকে উদ্ধার করা হয় এবং কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অপারেশন শেষ হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির মতে, ২০১২ সালের পর থেকে সোমালি জলদস্যুতার সংখ্যা কমলেও ২০২৩ এর শেষভাগে তা আবার বাড়তে শুরু করে। হুথি হামলার জেরে পশ্চিমা নৌ সামর্থ্যের ফোকাস রেড সি অঞ্চলে চলে যাওয়ায় শূন্যতা তৈরি হয়, আর সেই ফাঁকেই সোমালি জলদস্যুরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
নভেম্বর ২০২৩ থেকে অন্তত ২০টির বেশি হাইজ্যাক বা প্রচেষ্টা নথিভুক্ত হয়েছে। আইএমবি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসেই বিশ্বজুড়ে ৩৩টি দস্যুতা বা সশস্ত্র ডাকাতি ঘটেছে যা আগের বছরের তুলনায় বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্ত উপস্থিতি অনেকাংশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধজাহাজ, নৌ–কমান্ডো ও পি-৮আই নজরদারি বিমানের সমন্বিত অভিযান জলদস্যুদের অপ্রস্তুত করে তোলে। কেবল ধাওয়া দিয়ে তাড়ানো নয়, আত্মসমর্পণ করানো জলদস্যুদের ভারতে বিচারের আওতায় আনা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতীয় নৌবাহিনী কেবল ভারতীয় জাহাজ নয়, বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করছে। শুধু ভারতীয় নয়, বুলগেরীয়, ইরানি, পাকিস্তানি বিভিন্ন দেশের নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছে। এর ফলে ভারত আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জন করছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই ভূমিকা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে।
দিল্লিভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অবিনাশ সিংয়ের কথায়, “আজ ভারতীয় নৌবাহিনী শুধু নিজের দেশ নয়, গোটা অঞ্চলের নৌ–সুরক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সোমালিয়ার জলদস্যুরা জানে, ভারতীয় জাহাজ সামনে পড়লে তাদের জন্য অপারেশন প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।”
মুম্বইয়ের মেরিটাইম গবেষক অনন্যা রায় মন্তব্য করেন, “ভারত যে কেবল প্রতিরক্ষা নয়, মানবিক দিক থেকেও দায়িত্ব নিচ্ছে, তা বিশ্ব রাজনীতিতে বড় বার্তা দিচ্ছে। পাকিস্তানি জেলেদের উদ্ধার তার বড় উদাহরণ।” আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক করিডর আজ ভূ–রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্র। জলদস্যুদের তৎপরতা সেই প্রতিযোগিতাকে আরও জটিল করছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় নৌবাহিনী কার্যত একমাত্র শক্তি, যারা নির্ভরযোগ্যভাবে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক ও মানবিক সুরক্ষা দিতে পারছে। এ কারণেই সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছে এখন ভারতীয় নৌবাহিনী সবচেয়ে বড় আতঙ্ক।