এএফপি : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও হাজারো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। ১৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় ভর্তি ও ভিসা পাওয়া শিক্ষার্থীরা এখন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

দেশটির গণমাধ্যম এবিসি নিউজ গতকাল রোববার এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য ধরে তৈরি করা মাকিয়া সেমিনেরের সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর মে থেকে এই বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৯টি দেশের ৫ হাজার ৭০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী এফ-১ ও জে-১ ভিসা পেয়েছিলেন। এর অর্ধেকের বেশি ভিসা পেয়েছেন ইরান ও মিয়ানমারের শিক্ষার্থীরা। তবে নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেকে ভর্তির সুযোগ পেয়েও বা ভর্তি হয়েও যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারছেন না। ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে কলেজে পড়তে যেতে পারছেন না। এই শরতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিকল্পনা করা ১৯ দেশের হাজারো শিক্ষার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আফগানিস্তান, মিয়ানমার, চাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, ইয়েমেন, বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

প্রতিবেদনের শুরুতেই বাহারা সাঘারি নামের এক আফগান শিক্ষার্থীর কথা তুলে ধরা হয়েছে। তালেবান সরকার তাঁর জন্মভূমি আফগানিস্তানে নারীদের কলেজে পড়াশোনা নিষিদ্ধ করার পর বাহারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য কাজ শুরু করেন। ২১ বছর বয়সী বাহারা কয়েক বছর ধরে দিনে আট ঘণ্টা ইংরেজি অনুশীলন করেন। অবশেষে ইলিনয়ের একটি বেসরকারি লিবারেল আর্টস কলেজের ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার সুযোগ পান। তিনি এই শরতে পড়তে যাওয়ার পরিকল্পনা ও স্বপ্ন বুনছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা আবারও ভেস্তে গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে।

বাহারা সাঘারি এবিসিকে বলেছেন, ‘একবার ভাবুন, আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণের পথে, তারপর কিছু একটা এল এবং সবকিছুই শেষ হয়ে গেল।’

ট্রাম্প প্রশাসনের ১৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাহারা সাঘারির মতো হাজারো শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার জন্য যথেষ্ট সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করে নিজ দেশে আটকে পড়ে আছেন।

ভিসা আবেদনের জটিলতার কারণে ভর্তির প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও এই শরতে কিছু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসে আসতে পারছেন না; যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এই গ্রীষ্মে অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই শুরু করার সময় এ প্রক্রিয়া (ভিসা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা ও অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই) ধীর করে দিয়েছে। প্রশাসনের ব্যাপক অভিবাসন কঠোর ব্যবস্থা এবং কিছু শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল বা আটকে থাকার কারণে অন্যরা দ্বিতীয় চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। তাঁরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছেন না।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী বিকল্প হিসেবে ইউরোপ ও অন্য দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করছেন। তবে ভিসা শর্ত, ভাষা পরীক্ষা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেখানেও অনেকে নতুন জটিলতায় পড়েছেন। ইরানের শিরাজ এলাকার ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী পুইয়া কারামি বিজ্ঞানে গবেষণাকাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চায়। সে বলে, বিজ্ঞানে একই রকম গবেষণার সুযোগ অন্য কোনো দেশ দেয় না। সে এই শরতে কানসাসের পিটসবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পলিমার রসায়ন পড়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই পরিকল্পনা স্থগিত করতে হয়েছে।

পুইয়া কারামি আগামী বছর পর্যন্ত ভর্তির জন্য অপেক্ষায় আছে এবং আশায়ও আছে। সে এখনো তার দূতাবাসের সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার বিধিনিষেধ পুনর্বিবেচনা করার জন্য মার্কিন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এটি সম্পর্কে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি দেশের নাগরিকদের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। এ নিষেধাজ্ঞা বেশির ভাগ লোককে নতুন করে ভিসা পেতে দিচ্ছে না। যদিও এসব দেশের কিছু নাগরিক গ্রিন কার্ডধারী, দ্বৈত নাগরিক এবং কিছু ক্রীড়াবিদও আছেন। এই ১২টি দেশের বাইরে আরও ৭টি দেশ কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে, যা ছাত্র ভিসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

মিয়ানমারের ১৮ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীর পরিবার তাঁর শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য অর্থ জমা করে রেখেছে। তারা তাদের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে ফেলেছে, যাতে ছাত্রটি উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পান। ওই শিক্ষার্থী কেবল তাঁর ডাকনাম গু গু বলে এবিসির কাছে পরিচয় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কারণ, সমালোচনা প্রকাশ করার জন্য মিয়ানমার বা মার্কিন সরকারের লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন বলে তিনি চিন্তিত।

গু গু বলেন, তিনি একটি পারিবারিক চ্যাটে গ্রুপ সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগের খবরের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছিলেন। তখন সবার ইমোজিতে ভরে গেল চ্যাট গ্রুপ। তিনি ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের অপেক্ষায় ছিলেন, তখন এক রাতে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মার্কিন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার খবর জানান। মুহূর্তের মধ্যেই এই শরতে সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।

২০২১ সালে সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর থেকে মিয়ানমারে ওই শিক্ষার্থীর বয়সী অনেক ছাত্রকে সেনাবাহিনীতে পাঠানো হয়েছে অথবা প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিতে হয়েছে। গৃহযুদ্ধ যখন তীব্র হচ্ছে, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একা স্কুলে যাওয়া বা আবার খেলাধুলা করার মতো সহজ স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গু গু বলছিলেন, ‘আমি সম্পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম, তাই এ ধরনের খবরে আমার হৃদয় ভেঙে যায়।’

আফগানিস্তানের ছাত্রী বাহারা সাঘারি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কথা জানার পর পাকিস্তানে তাঁর জুলাই মাসের ভিসা সাক্ষাৎকারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করে দেন। নক্স কলেজ তাঁর ভর্তি স্থগিত করার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে তিনি ইউরোপের স্কুলগুলোয় আবেদন করেছিলেন, কিন্তু ভর্তিপ্রক্রিয়ায় সমস্যার সম্মুখীন হন। একটি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় বাহারাকে বলেছিল, তাঁকে আরেকটি ইংরেজি দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হবে, কারণ তাঁর আগের সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশে প্রথমবার পরীক্ষা দেওয়া ইতিমধ্যেই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।

বাহারা সাঘারিকে পোলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে এই শর্তে যে তাঁকে তাঁর টিউশন ফি আগে থেকে দিতে হবে।

২৮ বছর বয়সী ইরানের স্নাতক শিক্ষার্থী আমির লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ভয়ে তাঁর পদবি প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করতে পারেননি। এর পরিবর্তে তিনি তেহরানে একজন গবেষক হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা পরিচালনার সম্পূর্ণ অর্থায়নের সুযোগ হাতছাড়া করার পর মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমিরের গবেষক হিসেবে নিয়োগ আগামী বছর পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন পেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক। আমিরের কিছুটা হলেও সুযোগ আছে। কিন্তু আমির বলছেন, ‘এটি “অন্ধকারে একটি গুলি”র মতো মনে হচ্ছে আমার কাছে।’

আমির ইউরোপে গবেষণার সুযোগ খুঁজছেন। এ জন্য আবেদনে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে হবে এবং সম্ভাব্যভাবে একটি নতুন ভাষাও শেখার প্রয়োজন হবে। তিনি এখনো যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পছন্দ করেন। তিনি বলেন, তবে তিনি আশাবাদী নন যে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হতে চলেছে। তিনি বলেন, ‘যদি আপনি কঠোর পরিশ্রম করেন, যদি প্রতিভাবান হন, যদি কিছু অবদান রাখেন, তাহলে আপনার জন্য অন্য কোথাও একটা জায়গা আছে, এমন কোথাও, যেখানে থাকতে চান এবং এরপর যখন জানতে পারবেন, মানুষ সেখানে আপনাকে চায় না। এটা মোকাবিলা করা একটু বেশি কঠিন।’