রয়টার্স : মার্কিন মুলুকে ছয়মাস ধরে অনিশ্চয়তা নিয়ে টিকে আছেন কাতেরিনা গোলিজদ্রা। ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি সামলে আর মাস ছয় হয়তো তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব। তার মতো আরও প্রায় দু লাখ ৬০ হাজার ইউক্রেনীয় শরণার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকার মেয়াদ গত মে মাসে শেষ হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্বাসনের ঝুঁকিতে পড়ে যান কাতেরিনা। তার কাজের অনুমতিপত্র বাতিল হয় এবং তাকে ফোর্ট লডারডেলের রিটজ-কার্লটনে ম্যানেজার পদটিও ছেড়ে দিতে হয়, যেখানে তিনি বছরে ৫০ হাজার ডলারের বেশি আয় করতেন। একই সঙ্গে তিনি হারান স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা। জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া মায়ের কাছেও আর টাকা পাঠাতে পারছেন না তিনি।ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোরতার কারণে বেশিরভাগ ইউক্রেনীয় শরণার্থী এখন আইনি মর্যাদা হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ মানুষের ভাগ্য অনিশ্চিত ছিল বলে রয়টার্সের যাচাই করা অভ্যন্তরীণ সরকারি নথিতে উল্লেখ আছে।

বাইডেন প্রশাসনের আমলে ২০২২ সালের এপ্রিলে চালু হওয়া ওই মানবিক কর্মসূচির আওতায় প্রায় দু লাখ ৬০ হাজার ইউক্রেনীয়কে প্রথমে দুই বছরের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৫৯ লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থীর তুলনায় এটি খুবই ছোট একটি অংশ।

গোলিজদ্রা বলেন, তিনি জানেন না, তার থাকার অনুমতি কখন, বা আদৌ নবায়ন হবে কিনা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া স্বল্পস্থায়ী নিরাপত্তা বোধ এখন আবারও অনিশ্চয়তায় ঘেরা। এ অবস্থায় তার মতো আশ্রয়গ্রহণকারীরা ফেডারেল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হওয়ার ঝুঁকিতেও আছেন বলে তিনজন সাবেক অভিবাসন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান।

নিরবচ্ছিন্ন মানসিক চাপ: গত ছয় মাস ধরে টানা মানসিক চাপে আছেন উল্লেখ করে কাতেরিনা বলেন, এটা একটা স্থায়ী চাপ আর উদ্বেগ। যদি আমাকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হয়, তবে আবার সব শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। এমন দুই ডজন ইউক্রেনীয়ের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা তাদের কাজের অনুমতি এবং চাকরি হারিয়েছেন এই জটিলতার কারণে। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রযুক্তি খাতের কর্মী, প্রিস্কুল শিক্ষক, ফাইন্যান্স উপদেষ্টা, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ও এক কলেজ শিক্ষার্থী। তারা জানাচ্ছেন, সঞ্চয় ভাঙা, কমিউনিটির সহায়তা খোঁজা, এমনকি ঋণ নিতে বাধ্য হওয়া এই সব উপায়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তারা। কেউ কেউ বলেন, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে ঘরের বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন তারা। আবার অনেকে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে কানাডা, ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকায় চলে গেছেন। ইউক্রেনে ফিরে যাওয়া আপাতত কারও জন্যই বিকল্প পথ নয়। বুচা শহরে কাতেরিনার বাড়ি ২০২২ সালের মার্চে রুশ বাহিনীর হামলায় আগুনে পুড়ে যায়। ইউক্রেনীয় বাহিনী শহরটি মুক্ত করার পর শত শত বেসামরিক মানুষের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ট্রাম্প প্রশাসন জানুয়ারিতে নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করে ইউক্রেনীয়দের মানবিক কর্মসূচির আবেদন ও নবায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করে। আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক উত্তপ্ত সাক্ষাতের পর মার্চে ট্রাম্প বলেন, তিনি পুরো কর্মসূচি বাতিল করার বিষয়টি বিবেচনা করছেন।

শেষ পর্যন্ত তিনি তা বাতিল করেননি, বরং মে মাসে এক ফেডারেল বিচারক নবায়ন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেন। কিন্তু এরপর থেকে মাত্র এক ৯০০টি আবেদন প্রক্রিয়া করা হয়েছে, যা মেয়াদোত্তীর্ণদের তুলনায় খুবই কম। এছাড়া, জুলাইয়ে এসব আবেদনের জন্য মাথাপিছু এক হাজার ডলার বাড়তি ফি যোগ হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রয়টার্সের অনুরোধে হোয়াইট হাউজ এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কোনও সাড়া দেয়নি। শিকাগোর ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান মাইক কুইগলি বলেন, তার অফিসে দুই শতাধিক ইউক্রেনীয় সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ করেছেন। অনেকের ভয়, যদি তারা পুরো আবেদন প্রক্রিয়া শেষ না করে, তাহলে তারা নির্বাসনের ঝুঁকিতে পড়বেন।

ইউক্রেন ইমিগ্রেশন টাস্ক ফোর্সের নির্বাহী পরিচালক অ্যান স্মিথ বলেন, তারা প্রতি সপ্তাহে কোনও না কোনও পরিবারের সদস্য গ্রেফতার হওয়ার খবর সংক্রান্ত একাধিক ফোন পান । কেউ নির্মাণকাজ করতে গিয়ে, কেউ খাবার ডেলিভারি বা উবার চালাতে গিয়ে, আবার কেউ বৃহত্তর অভিযানগুলোর সময়ে আটক হয়েছেন। নর্থ ক্যারোলিনার র্যালিতে বসবাসকারী ব্রায়ান স্নাইডার তিনটি ইউক্রেনীয় পরিবারকে স্পনসর করেছেন। তিনি বলেন, নিয়ম মেনে চলা মানুষদের ওপর এমন আচরণ অন্যায্য।

নিজে থেকেই দেশত্যাগ : সাক্ষাৎকার দেওয়া ২৪ জনের মধ্যে ছয়জন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে গেছেন। ইমিগ্রেশন জেলে যাওয়া বা ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা আফ্রিকায় নির্বাসনের ঝুঁকি নিয়ে চলার চেয়ে এটাই তারা নিরাপদ মনে করেছেন। ইয়েভহেনি পাডাফা, ৩১ বছর বয়সী এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, গত মার্চে তার নবায়ন আবেদন জমা দেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ঝুলে থাকে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। তার আশঙ্কা, অবৈধ অবস্থায় থাকলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি সরকারী অ্যাপ ‘সিবিপি ওয়ান’ ব্যবহার করে স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করেন। ট্রাম্প প্রশাসন মে মাসে ঘোষণা করেছিল, অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে বিমান টিকিট ও এক হাজার ডলারের এক্সিট বোনাস দেওয়া হবে। পাডাফা আর্জেন্টিনায় যেতে চেয়েছিলেন, যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম এবং ইউক্রেনীয়দের জন্য মানবিক কর্মসূচি আছে। কিন্তু অ্যাপ তার জন্য আর্জেন্টিনার টিকিট বুক করেনি। এক মার্কিন বর্ডার কর্মকর্তা বলেন, ফ্লাইটটি ইউক্রেনের জন্য বুক করতে হবে। অল্প টাকা নিয়ে নভেম্বরে বুয়েনোস আইরেস পৌঁছে তিনি ভাড়ার জন্য নিজের ল্যাপটপ বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন। তিনি বলেন, যদি ইউক্রেন ফিরি, তবে সরাসরি যুদ্ধের মাঝে পড়তে হবে। তার চেয়ে অন্য কোথাও গৃহহীন হওয়া ভালো।