নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সঙ্গে গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে বৈঠককালে একটি কথা বলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, জোহরান তাকে ফ্যাসিবাদী বলতে চাইলে বলতে পারেন। এতে তিনি কিছু মনে করবেন না। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এনডিটিভি, রয়টার্স, বিবিসি।

নির্বাচনী প্রচারের সময় জোহরান মামদানিকে বিভিন্ন সময় বলতে শোনা গেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ফ্যাসিবাদী। এর সূত্র ধরেই এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, তিনি এখনো ট্রাম্পকে ফ্যাসিবাদী মনে করেন কি না।

প্রশ্নের উত্তরে জোহরান বলতে শুরু করেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলেছি...। এতটুকু বলতেই ট্রাম্প তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি শুধু হ্যাঁ বলেই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। ব্যাখ্যা দেওয়ার চেয়ে এটিই বেশি সহজ হবে। আমি কিছু মনে করব না।’

সিএনএনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজ সকালে ট্রাম্প বলেছেন, ওভাল অফিসে জোহরান মামদানির সঙ্গে তাঁর দারুণ এক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল।

নিউইয়র্কে জন্ম নেওয়া ট্রাম্প তাঁর শহরের মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় জোহরানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আবাসন খাতে উন্নয়ন ও খাদ্যের বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁরা একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দারুণ একটি বৈঠক করলাম। এটি সত্যিই ভালো ও ফলপ্রসূ ছিল। একটা বিষয়ে আমরা মিল খুঁজে পেয়েছি। সেটা হলো আমরা দুজনেই আমাদের এই প্রিয় শহরকে আরও ভালো রাখতে চাই। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমরা আবাসন, আবাসন নির্মাণ এবং খাদ্যের দামসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছি। তেলের দাম এখন অনেক কমে আসছে।’

ট্রাম্প বলেন, ‘আপনারা একজন দারুণ মেয়র পেতে যাচ্ছেন। তিনি যত ভালো কাজ করবেন, আমি তত খুশি হব। এখানে দলীয় কোনো বিভেদ নেই। আমি মনে করি, তিনি কিছু রক্ষণশীল মানুষকে যেমন চমকে দেবেন, তেমনি কিছু অত্যন্ত উদারপন্থী মানুষকেও।’

প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়ানো জোহরান ট্রাম্পের কথায় একমত প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। নিউইয়র্কের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সংকট মোকাবিলার বিষয়কে কেন্দ্র করেই বেশির ভাগ আলোচনা হয়েছে। আমরা ভাড়ার বিষয়ে কথা বলেছি, নিত্যপণ্য নিয়ে কথা বলেছি, ইউটিলিটি বিল নিয়ে কথা বলেছি।’

নিউইয়র্কবাসীকে একটি সাশ্রয়ী জীবন উপহার দিতে ট্রাম্পের সঙ্গে ভবিষ্যতে কাজ করার আশাবাদও ব্যক্ত করেন নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান।

হোয়াইট হাউসে পরস্পরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প-মামদানি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের মেয়র জোহরান মামদানির সাক্ষাৎ কোনও জটিলতা ছাড়াই শেষ হলো। সামনাসামনি না এসেই দুজন যেভাবে তীব্র বাক্যবাণে একে অপরকে নাস্তানাবুদ করার খেলায় নেমেছিলেন, গত শুক্রবার মুখোমুখি হয়ে বরং পরস্পরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছে।

ওভাল অফিসে গত শুক্রবার দু’জনই নিউ ইয়র্ক সিটির জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট মোকাবিলায় যৌথ আগ্রহের কথা বারবার উল্লেখ করেন। তারা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন, এমনকি মামদানি তার বিরুদ্ধে নির্বাচনি প্রচারে করা আক্রমণাত্মক মন্তব্য নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ট্রাম্পকেও হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়।

গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়া মামদানিকে এর আগে ‘স্বৈরাচার’ বলেছিলেন ট্রাম্প। আর বৈঠকের আগেই ট্রাম্পের মুখপাত্র মামদানির হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণে বিরক্ত হয়ে ‘একজন কমিউনিস্টের আগমন’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাই, তাদের নমনীয়তা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিস্মিত হয়েছেন।

তবে এটি ইঙ্গিত দেয় যে দু’জনই উপলব্ধি করছেনÑনিউ ইয়র্কের সংকট সমাধান তাদের রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্পের মুখে মামদানির প্রশংসা

ব্যক্তিগত বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে দু’জনের বোঝাপড়ার ছাপ স্পষ্ট ছিল। ট্রাম্পের ডান পাশে হাত জোড় করে দাঁড়ান মামদানি, আর ট্রাম্প রেজলিউট ডেস্কের পেছনে আরামদায়ক ভঙ্গিতে বসে থাকেন।

ট্রাম্প কোনও আক্রমণাত্মক মন্তব্য না করে বরং মামদানিকে একাধিকবার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, মামদানি একজন সত্যিকারের ভালো মেয়র হবেন বলে তিনি আশা করেন।

পরে তিনি আরও বলেন, তিনি খুব ভালো কাজ করতে পারবেন বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস।

‘জিহাদ’ ও ‘ফ্যাসিবাদ’ ইস্যু এড়িয়ে যাওয়া

নির্বাচনকালীন দু’জনই একে অন্যের বিরুদ্ধে কঠোর রাজনৈতিক মন্তব্য করেছিলেন। এক সাংবাদিক তাদের সেই পুরোনো মন্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিলে দু’জনই বিষয়টি একপাশে রেখে আবারও প্রশংসামূলক সুরে ফিরে যান।

ট্রাম্প এমনকি মামদানিকে সুযোগ দেন প্রেসিডেন্টকে “ফ্যাসিস্ট” মনে করেন কি না—এ প্রশ্নের উত্তর দিতে। হাসতে হাসতে ট্রাম্প বলেন, “ঠিক আছে, চাইলে ‘হ্যাঁ’ বলুন, ব্যাখ্যা করার চেয়ে সেটা সহজ।

হবু মেয়রকে নিয়ে গতকাল ট্রাম্পের সবচেয়ে কঠোর মন্তব্য ছিল, ‘মামদানির কিছু মতামত একটু বাড়াবাড়ি’।

সম্মেলনের এক পর্যায়ে, নিউ ইয়র্কের রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান এলিস স্টেফানিকের দাবি উদ্ধৃত করে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, ট্রাম্প কি এখন একজন ‘জিহাদির’ পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বলে মনে করেন কিনা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, না, আমি তা মনে করি না।

প্রেসিডেন্ট বলেন, প্রচারণায় অনেক কথাই বলা হয়। তবে তিনি খুব যোগ্য একজন মানুষ।

মামদানি ও ট্রাম্পের একটি মিল হলো, তারা দু’জনেই নিউ ইয়র্কের মানুষ—বিশেষত কুইন্সের সঙ্গে তাদের সংযোগ রয়েছে। ট্রাম্পের শৈশব কেটেছে জ্যামাইকা এস্টেটসে, আর মামদানি থাকেন অ্যাস্টোরিয়ায়।

মামদানির ভাষায়, নিউ ইয়র্ক শহর নিয়ে তাদের ছিল “সামাজিক ভালোবাসা। ট্রাম্পও নিজের ছোটবেলার শহর নিয়ে সস্নেহ ভঙ্গিতে কথা বলেন। তিনি বলেন, এই শহর অসাধারণ হতে পারে—যদি মামদানি সাফল্য অর্জন করে, আমি খুব খুশি হব।

ব্যয় সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তা

দু’জনের একই সুরের অন্যতম কারণ হলো নিউ ইয়র্কের ব্যয়সংকট মোকাবিলায় তাদের অভিন্ন অগ্রাধিকার। ২০২৪ সালের ভোটারদের ক্রয়ক্ষমতাÑসংকট ও মূল্যস্ফীতির ক্ষোভকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প পুনর্র্নিবাচিত হন।

অন্যদিকে, মামদানি তার পুরো নির্বাচনী প্রচারে জোর দেন আবাসন সংকট ও বাড়িভাড়া বৃদ্ধির সমস্যায়। মামদানি জানান, তিনি ও ট্রাম্প আলোচনা করেছেন কীভাবে নিউ ইয়র্কবাসীর এই সংকট সমাধান করা যায়।

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি বা মতাদর্শগত ভিন্নমত নিয়ে প্রশ্ন এলে মামদানি আবারও ব্যয়ের সংকটে ফিরে আসেন।

আইনশৃঙ্খলা ও অভিবাসন নিয়েও তাদের কিছু মিল পাওয়া যায়। মামদানি বলেন, নিউ ইয়র্কে ফেডারেল অভিবাসন অভিযানের বিষয়ে জনগণের উদ্বেগ তিনি ট্রাম্পকে জানিয়েছেন।

ট্রাম্প জানান, তারা অপরাধ মোকাবিলাকে অভিবাসনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মামদানি মেয়র হলে তিনি নিউ ইয়র্কে থাকতে নিরাপদ বোধ করবেন বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

রিপাবলিকানদের কৌশলে জটিলতা?

এই সৌহার্দ্যমূলক দৃশ্য ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে মামদানিকে ডেমোক্র্যাটদের ‘দুর্বলের প্রতীক’ হিসেবে ব্যবহার করার রিপাবলিকান পরিকল্পনাকে জটিল করতে পারে।

রিপাবলিকানরা তাকে ‘অ্যান্টি-পুলিশ’, ‘অ্যান্টি-ক্যাপিটালিস্ট’ ও ‘অ্যান্টি-ইসরায়েল’ হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ওভাল অফিসে দুই পক্ষের এই বন্ধুসুলভ আচরণ সেই কৌশলকে দুর্বল করতে পারে।

ট্রাম্প বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন মামদানি অনেক রক্ষণশীল মানুষকে বিস্মিত করবেন।