নিউইয়র্ক টাইমস,বিবিসি , রয়টার্স: টেসলার প্রধান ইলন মাস্ক বহু বছর ধরেই বিশ্বের ধনীদের তালিকায় শীর্ষে। সম্প্রতি তাঁর সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়েছে। প্রথমবারের মতো তিনি হয়েছেন ‘অর্ধ-ট্রিলিয়নিয়ার’(অর্থাৎ ৫০ হাজার কোটি ডলারের মালিক)। তবে এত সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন না মাস্ক—এমনটাই দাবি তাঁর। ২০২১ সালে এই ধনকুবের একবার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে যে বাড়িটিতে তিনি বসবাস করেন, সেটির দাম মাত্র ৫০ হাজার ডলার। ইলন মাস্কের সাবেক সঙ্গী কানাডীয় সংগীতশিল্পী গ্রাইমস ২০২২ সালে মার্কিন সাময়িকী ভ্যানিটি ফেয়ারকে বলেন, ‘মানুষ যেমন ভাবেন, আসলে তেমন বিলাসবহুল বা আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করেন না মাস্ক।’ ২০২২ সালে ইলন মাস্কের বড় খরচার তালিকায় আরেকটি বিষয় যোগ হয়। ওই বছর তিনি ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার দিয়ে কিনে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার। এর নতুন নাম দেন গ্রাইমস আরও বলেন, তিনি ধনকুবেরদের মতো জীবন যাপন করেন না। কখনো কখনো তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচেও বসবাস করেন। মাস্কের সাবেক এই সঙ্গী একবার বলেছিলেন, তাঁদের ম্যাট্রেসের এক পাশ ফুটো হয়ে যাওয়ার পরও নাকি মাস্ক নতুন ম্যাট্রেস কিনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মানুষ যেমনটা ভাবেন, ঠিক তেমন বিলাসবহুল বাড়ি হয় তো ইলন মাস্কের নেই। তবে ব্যতিক্রমধর্মী গাড়ির প্রতি তাঁর ভালোবাসা অগাধ। কোটি কোটি ডলারের জেট বিমানের একটি সংগ্রহশালা রয়েছে তাঁর। ২০২২ সালে ইলন মাস্কের বড় খরচের তালিকায় আরেকটি বিষয় যোগ হয়। ওই বছর তিনি ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার দিয়ে কিনে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার। এটির নতুন নাম দেন ‘এক্স’।

যেসব বিলাসবহুল বাড়ি বেচে দিয়েছিলেন মাস্ক: ইলন মাস্ক একসময় ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসের অভিজাত বেল-এয়ার এলাকায় সাতটি বাড়ির মালিক ছিলেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছিল, সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার ব্যয় করে তিনি ওইসব বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়িগুলোর ভেতরে ছিল সুইমিংপুল, টেনিস কোর্ট, ওয়াইন সেলার, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ও বলরুম। বাড়িগুলোর একটি একসময় ছিল কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের মালিকানাধীন। কিন্তু ২০২০ সালে ইলন মাস্ক তৎকালীন টুইটারে ঘোষণা দেন, তিনি তাঁর প্রায় সব স্থাবর সম্পত্তি বেচে দেবেন। তাঁর মালিকানায় আর কোনো বাড়ি থাকবে না। মাস্ক লেখেন, ‘আমার নগদ অর্থের দরকার নেই। আমি নিজেকে মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর জন্য উৎসর্গ করছি। সম্পদ শুধু বোঝা বাড়ায়।’ তবে ইলন মাস্ক একটি শর্ত দিয়েছিলেন, জিন ওয়াইল্ডারের বাড়িটি যেন ‘ধ্বংস না করা হয়’ এবং যাতে এটির ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হয়। ইলন মাস্ক সত্যিই তিন বেডরুমের ওই ঐতিহাসিক বাড়িটি ওয়াইল্ডারের ভাগনে জর্ডান ওয়াকার-পার্লম্যানের কাছে বিক্রি করেছিলেন। এমনকি বাড়িটি কেনার জন্য তাঁকে কয়েক লাখ ডলারের ঋণও দিয়েছেন। কিন্তু ২০২৫ সালের জুনে মাস্ক আবার বাড়িটির মালিকানা ফিরে পান। কারণ, ওয়াকার-পার্লম্যান ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। ২০২১ সালে মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, তাঁর মূল বাড়ি টেক্সাসের দক্ষিণে অবস্থিত। এটির দাম মাত্র ৫০ হাজার ডলার। ওই এলাকা থেকেই তাঁর মালিকানাধীন মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

বাড়িটি সম্পর্কে মাস্ক বলেন, ‘এটি আসলে দারুণ।’ অবশ্য এর এক বছর পর ইলন মাস্ক বলেন, তাঁর নিজের মালিকানায় কোনো বাড়ি নেই। বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি কতটা সাদামাটা জীবন যাপন করেন, তার উদাহরণ দিতে গিয়েই এ কথা বলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থা টেড টকের প্রধান ক্রিস অ্যান্ডারসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইলন মাস্ক বলেন, ‘আমি আসলে আমার বন্ধুদের বাড়িতে থাকি। টেসলার বেশির ভাগ প্রকৌশল কাজ হয় বে এরিয়ায়। সেখানে গেলে আমি পালা করে বন্ধুদের বাড়িতে থাকি। এটা নতুন কিছু নয়। এমনকি ২০১৫ সালে গুগলের তৎকালীন সিইও ল্যারি পেজ বলেছিলেন, ‘তিনি (ইলন মাস্ক) তো একপ্রকার গৃহহীন। সে ই-মেইল পাঠিয়ে বলবে, “আজ রাতে কোথায় থাকব জানি না, তোমার বাড়িতে থাকা যাবে?”’

যদিও নানা জল্পনা–কল্পনা শোনা যাচ্ছে, কয়েক বছর ধরে মাস্ক আবার যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে সম্পত্তি কিনছেন। তবে বর্তমানে টেক্সাসের বাড়িটিই তাঁর মালিকানাধীন একমাত্র বাড়ি বলেই জানা গেছে। ইলন মাস্ক একসময় ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসের অভিজাত বেল-এয়ার এলাকায় সাতটি বাড়ির মালিক ছিলেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছিল, সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার ব্যয় করে তিনি ওই বাড়িগুলো কিনেছিলেন।

বিরল গাড়ির সংগ্রহ : বাড়িঘরের পেছন বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় না করলেও ইলন মাস্কের জন্য গাড়ির ব্যাপারটি আলাদা। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে অনেকগুলো ঐতিহাসিক ও দুর্লভ গাড়ি। ইলন মাস্কের সংগ্রহে আছে বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের একটি মডেল ‘টি’ সিরিজের গাড়ি। ১৯০৮ সালে এটি সাধারণ মানুষের জন্য প্রথম সাশ্রয়ী মূল্যের ও সহজলভ্য গাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়।

অন্যান্য গাড়ির মধ্যে মাস্কের কাছে আছে ১৯৬৭ সালের একটি জাগুয়ার ই-টাইপ রোডস্টার। শৈশব থেকেই এই গাড়ির শখ ছিল তাঁর। মাস্কের সংগ্রহে আছে ১৯৯৭ সালের একটি ম্যাকলারেন এফ১। এক দুর্ঘটনায় এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে অবশ্য অনেক অর্থ খরচ করে গাড়িটি মেরামত করে বিক্রি করে দেন তিনি। এ ছাড়া মাস্কের কাছে আছে একটি টেসলা রোডস্টার। এটি টেসলার প্রথম গাড়ি হিসেবে বাজারে এসেছিল। ২০১৮ সালে তিনি এটিকে মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, ইলন মাস্কের সংগ্রহে আছে ১৯৭৬ সালের জনপ্রিয় স্পোর্টস কার লোটাস এসপ্রিট। জেমস বন্ড সিরিজের সিনেমা ‘দ্য স্পাই হু লাভড মি’-তে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। সিনেমায় দেখানো হয়, গাড়িটি সাবমেরিনে পরিণত হতে পারত। বাস্তবে এটিকে সাবমেরিনে রূপ দেওয়ার জন্য ইলন মাস্ক ২০১৩ সালে প্রায় ১০ লাখ ডলারে গাড়িটি নিলামে কিনে নেন। মাস্কের সংগ্রহে রয়েছে গালফস্ট্রিম মডেলের একাধিক উড়োজাহাজ। এগুলোর একেকটির দাম কয়েক কোটি ডলার।

আকাশে ওড়ার বিলাসিতা : মাস্ক স্বীকার করেছেন, তিনি যেসব জিনিসের পেছনে অর্থ ওড়াতে পছন্দ করেন, তার মধ্যে আরেকটি হলো উড়োজাহাজ। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, কাজের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তিনি উড়োজাহাজ কেনেন। টেড টকে মাস্ক বলেন, ‘আমি যদি উড়োজাহাজ ব্যবহার না করি, তাহলে কাজ করার জন্য অপেক্ষাকৃত কম সময় পাই।’ মাস্কের সংগ্রহে রয়েছে গালফস্ট্রিম মডেলের একাধিক উড়োজাহাজ। এগুলোর একেকটির দাম কয়েক কোটি ডলার। এসব উড়োজাহাজে চড়ে মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে স্পেসএক্স ও টেসলার বিভিন্ন কার্যালয়ে যাতায়াত করেন, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সফরেও যান। ‘সে (ইলন মাস্ক) তো একপ্রকার গৃহহীন। সে ই-মেইল পাঠিয়ে বলবে, ‘আজ রাতে কোথায় থাকব জানি না, তোমার বাড়িতে থাকা যাবে?’

দানশীলতা নাকি কৌশল : মাস্ক বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় শত শত কোটি ডলারের শেয়ার দান করেছেন এবং বহু প্রকল্পে অনুদান দিয়েছেন। তবে এসব দান নিয়ে সমালোচনা আছে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, মাস্কের দান ‘খুবই বিশৃঙ্খল ও স্বার্থান্বেষী’। এ কারণে তিনি বিপুল করছাড় পান এবং তাঁর ব্যবসারও উপকার হয়। দাতব্য সংস্থা মাস্ক ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে লেখা আছে, এই ফাউন্ডেশন ‘মানবতার অগ্রগতির জন্য বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে নিবেদিত।’ কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিন বছর ধরে ফাউন্ডেশনটি আইন অনুযায়ী যত অর্থ অনুদান দেওয়ার কথা ছিল, তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক অনুদান আবার গেছে মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই। মাস্ক ও তাঁর ফাউন্ডেশনের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য জন্য অনুরোধ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।