এএফপি: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল শুক্রবার ঘোষিত নতুন আমদানি শুল্ক কাঠামোতে কিছুটা ছাড় দেওয়ায় কিছু এশীয় দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তবে অনেক দেশ এখনও অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগে রয়েছে। বিশেষ করে ট্রানশিপমেন্ট পণ্য ও জাপানি গাড়ির ওপর শুল্ক নিয়ে। ফরাসি বার্তা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

এই নতুন ঘোষণায় বেশ কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক হার কমিয়ে আনা হয়েছে এবং কার্যকর হওয়ার সময়সীমা এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৭ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান আলোচনা এই ঘোষণার আওতায় আসেনি। তবে এশিয়ার অন্য দেশগুলো এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। হোয়াইট হাউসের ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।

বাংলাদেশের ‘চূড়ান্ত কূটনৈতিক বিজয়’: বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তির আগে ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপের হুমকি ছিল। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি যুগান্তকারী বাণিজ্য চুক্তি করায় বাংলাদেশের শুল্ক নিয়ে আলোচকদের আমরা গর্বের সঙ্গে অভিনন্দন জানাই, যা একটি চূড়ান্ত কূটনৈতিক বিজয়। তিনি আরও বলেছেন, তিনি বলেন, এ অর্জন শুধু বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শক্তিকেই তুলে ধরেছে না, বরং বৃহত্তর সুযোগ, ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধির দ্বারও উন্মুক্ত করেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল।

থাইল্যান্ডের ‘বড় অর্জন’: থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার জন্য ঘোষিত ১৯ শতাংশ শুল্ক হার পূর্বে ঘোষিত ৩৬ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ছাড়। সম্প্রতি সীমান্ত সংঘাতে ৪০ জনের বেশি নিহত হওয়ার পর এমন ঘোষণা থাইল্যান্ডের জন্য আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ড সরকার একে ‘একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন’ এবং ‘রফতানি খাত ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য সমঝোতা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাইল্যান্ডের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৫.৬ বিলিয়ন ডলার। দেশটির প্রধান রফতানি পণ্য হলো যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও গাড়ির যন্ত্রাংশ।

কম্বোডিয়ার জন্য ‘সেরা খবর’ : কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত এই শুল্ক ছাড়কে ‘কম্বোডিয়ার জনগণ ও অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে সুখবর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জন্য সস্তা পোশাক উৎপাদনে এগিয়ে থাকা কম্বোডিয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এমনটি হলে দেশটির অর্থনীতিতে বড় আঘাত হতো। এদিকে প্রতিবেশী ভিয়েতনাম চলতি জুলাইয়ের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক সমঝোতায় পৌঁছে ২০ শতাংশ শুল্কে সম্মত হয়েছে।

ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে উদ্বেগ: যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে (ট্রান্সশিপমেন্ট) ৪০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যাদের উৎপাদন ব্যবস্থা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্ক সরাসরি কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কম্বোডিয়ার অনেক কারখানা চীনা মালিকানাধীন। তারা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর আগে সেখানে ‘স্টপওভার’ করিয়ে চীনের ওপর প্রযোজ্য উচ্চ শুল্ক এড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

তাইওয়ান এখনও ‘ছাড়’ চায়: তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে দেশটির জন্য ঘোষিত ২০ শতাংশ শুল্ককে ‘অস্থায়ী’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, চুক্তি হলে আরও ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রাম্প এর আগে তাইওয়ানের জন্য ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন। এর আওতায় দেশটির অন্যতম রফতানি পণ্য সেমিকন্ডাক্টরও পড়ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই চিপসহ উচ্চপ্রযুক্তির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়েছে। এর ফলে দেশটি ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক কৌশলের নিশানায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হসিয়াও বি-কিম বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে টেকসই সরবরাহ শৃঙ্খলা ও উচ্চপ্রযুক্তি উৎপাদনে তাইওয়ানের প্রয়োজন।

জাপানে গাড়ি নিয়ে বিভ্রান্তি : গত সপ্তাহে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ শুল্কে একমত হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের মতে এটি ২৫ শতাংশের পূর্বঘোষিত হুমকির তুলনায় ছাড়। তবে বাস্তবে জাপানি গাড়ি রফতানির ওপর আগেই ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর রয়েছে। এ বিষয়ে টোকিও এখনও স্পষ্ট হতে পারেনি। জাপানের সরকার মুখপাত্র ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেছেন, জাপান যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাবে যাতে সাম্প্রতিক চুক্তি অনুযায়ী দ্রুত শুল্ক হ্রাস কার্যকর করা হয়। বিশেষ করে গাড়ি ও অটো পার্টসের ক্ষেত্রে। তবে ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, জাপান যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং এতে ৯০ শতাংশ মুনাফা পুনরুদ্ধার করা যাবে। এই তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। চীনের সঙ্গে এখনও আলোচনা চলছে: চীনের ওপর প্রযোজ্য শুল্ক এই ঘোষণার বাইরে থাকলেও ১২ আগস্টের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, এশিয়ার অন্যান্য দেশ এই আলোচনার গতিপ্রকৃতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, কারণ চূড়ান্ত চুক্তি অনেক দেশকেই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে।