­ডন, সিএনএ, এএফপি রয়টার্স: যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ভয়াবহ বন্যায় প্রণহণির সংখ্যা বেড়ে ১০০ ছাড়িয়েছে। গত সোমবার এ তথ্য জানিয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছেন, এখনও আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। বিপর্যয়ের চার দিন পরেও নিখোঁজদের খোঁজে উদ্ধারকারী দলগুলো কাদামাটি জমা নদীর পাড় ঘেঁষে তল্লাশি চালাচ্ছে, যদিও নতুন করে কাউকে জীবিত উদ্ধারের আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। এর মধ্যেই আরও বৃষ্টি ও বজ্রঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কাউন্টি শেরিফের দপ্তর জানায়, নিহতদের মধ্যে ২২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ১০ জন শিশুর পরিচয় এখনও শনাক্ত করা যায়নি। আবহাওয়াবিদেরা আরও বন্যা হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছে। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী শুক্রবার টেক্সাস সফর করার পরিকল্পনা করছেন। আবহাওয়া সংস্থার বাজেট কাটছাঁটের কারণে সতর্কতা ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে বলে সমালোচকেরা যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটির কঠোর সমালোচনা করেছে হোয়াইট হাউজ।

চীন-নেপাল সীমান্তে ভয়াবহ বন্যা ॥ নিখোঁজ ২৮ : হিমালয়ের একটি উপত্যকায় প্রবল বৃষ্টিপাতে চীন ও নেপাল সীমান্তে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়াও এ ঘটনায় আরও ২৮ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রবল স্রোতের কারণে নেপাল ও চীনের সংযোগকারী প্রধান সেতুগুলোর একটি ভেঙে গেছে। এটি ভোটেকোশি নদীর ওপর নির্মিত ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকালে প্রাণঘাতী বন্যা ও ভূমিধস প্রায়ই ঘটে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব দুর্যোগ আরও মারাত্মক ও ঘন ঘন হচ্ছে। নেপালের জাতীয় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এক ব্যক্তি মারা গেছেন এবং আরও ১৭ জন নিখোঁজ রয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে ১১ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অরগানাইজেশন গত বছর সতর্ক করে বলেছিল, ঘন ঘন বন্যা ও খরার ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়াবহ বার্তা। এদিকে, কাঠমান্ডুভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট জুন মাসে সতর্ক করে বলেছিল, এ বছরের বর্ষায় পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ আরও বেশি বিপদের মুখোমুখি হতে পারে।

পাকিস্তানে বৃষ্টি-বন্যায় ১৯ জনের প্রাণহানি : পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া এবং ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির যমজ শহরে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানের জাতীয় জরুরি পরিচালনা কেন্দ্র সতর্কতা জারি করে জানিয়েছে, আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধান নদীগুলোর উজানে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। এতে করে বেশ কয়েকটি এলাকায় হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি হতে পারে। সতর্কতা জারির পর পাকিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিশেষ করে বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

বেলুচিস্তানে গত ৪৮ ঘণ্টায় নতুন মৌসুমি বৃষ্টিপাতে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছেন এবং অনেকেই আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। রাজ্যের প্রায় ২২টি জেলা এ বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আওরান, ঝাল ম্যাগসি, খুজদার, মুসাখাইল, কিলা সাইফুল্লাহ, বারখান, কহলু, লোরালাই, ও ঝব- শেরানি জেলার বিভিন্ন এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিডিএমএ জানিয়েছে, ২২টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত ও ৫টি ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরান সীমান্তবর্তী ওয়াশুক জেলাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে ফসল নষ্ট হয়েছে এবং অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ায় বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এছাড়া লোরালাই ও সুরাবে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি শহরের বিভিন্ন অংশে বৃষ্টিজনিত দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন শিশু। পুলিশ ও উদ্ধারকর্মীরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। খাইবার পাখতুনখাওয়ার মালাকান্দ, বুনের, মানসেহরা ও কারাক জেলায় বৃষ্টির কারণে আরও ৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

কলকাতা টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন: কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় টানা বৃষ্টির ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাযসহ দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলার নদীর পানি উপচে বন্যা দেখা দিয়েছে। চাষের জমি ও জনপদ প্লাবিত হয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার দিনভর হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি চলবে কলকাতা এবং দক্ষিণের জেলাগুলিতে। বৃষ্টির সঙ্গে ঘণ্টায় ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়াও বইতে পারে।

কলকাতা শহরে গত কয়েকদিন ধরে লাগাতার ভারী বৃষ্টিতে বহু রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ কলকাতা থেকে শুরু করে উত্তর শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি জমায় যান চলাচলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বহু জেলায় স্কুল-কলেজ ছুটি ঘোষণা করতে হয়েছে। রেললাইনে পানি জমার কারণে ট্রেন পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। শিয়ালদহ বিভাগের মেন লাইন এবং বনগাঁ শাখার বেশির ভাগ ট্রেন নির্ধারিত সময় থেকে দেরিতে চলছে। দক্ষিণের বেশির ভাগ জেলাতেই একই পরিস্থিতি। গত ২৪ ঘণ্টায় আলিপুরে ৮১.৬ মিলিমিটার, দমদমে ৯৯.৩ মিলিমিটার এবং সল্টলেকে ৮৮.৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। লালবাজার, ফিয়ার্স লেন, বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, নর্থ পোর্ট থানা এলাকাসহ বেশ কিছু জায়গা জলমগ্ন। কোথাও কোথাও পানি হাঁটু ছুঁয়েছে। বিভিন্ন গলিপথও জলমগ্ন। ফলে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা সর্বত্র ভোগান্তিতে পড়েছেন শহরবাসী। কলকাতা পৌরসভা সূত্রের খবর, প্রবল বৃষ্টির ফলে ঠনঠনিয়া, কলেজ স্ট্রিট, বৌবাজারের একাংশ থেকে শুরু করে বেহালা, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পানি জমেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসন ইতোমধ্যেই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ও রাজ্য বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা দফতর একাধিক জেলায় উদ্ধারকার্য শুরু করেছে। বহু পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে।

আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপটি আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও শক্তি সঞ্চয় করে গভীর নি¤œচাপে পরিণত হতে পারে। এর ফলে রাজ্যের উপকূলবর্তী ও সংলগ্ন জেলাগুলোতে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ের এই অকাল বৃষ্টি ও প্লাবনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমন ধানের বীজতলা ও শাকসবজি চাষে। রাজ্য সরকার কৃষকদের জন্য জরুরি ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে। এদিকে পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে নাগরিকদের অপ্রয়োজনে বাইরে না বেরোনোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি নদীবাঁধ ও খালগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে যাতে অতিরিক্ত জলস্রোতের ফলে বিপর্যয় না ঘটে। সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের সঙ্গে সাধারণ মানুষও যেন সক্রিয়ভাবে মোকাবিলায় অংশগ্রহণ করেন, সেই আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নেপালে আকস্মিক বন্যায় নিখোঁজ ১৮ জন: গতকাল মঙ্গলবার চীনের তিব্বত অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে ভোটে কোশি নদীতে বন্যার সৃষ্টি হয়। ফলে চীন ও নেপালের মধ্যে সংযোগকারী ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজটি ভেসে যায় বলে জানিয়েছেন নেপালের কর্মকর্তারা। এতে ১৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তিব্বতের হিমবাহ হ্রদের উপচে পড়া জলের ফলে বন্যা হতে পারে কারণ গত ২৪ ঘন্টায় নদীর তাৎক্ষণিক জলাধার এলাকায় কোনও ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। নেপালে কমপক্ষে ১৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন। অন্যদিকে চীনের সরকারি সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চলের চীনের পাশে ১১ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জাতীয় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এনডিআরআরএমএ) এক্স তারিখে জানিয়েছে, নেপালে নিখোঁজদের মধ্যে ছয়জন চীনা শ্রমিক এবং তিনজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এতে আরও বলা হয়েছে যে বন্যায় আটটি বৈদ্যুতিক গাড়িও ভেসে গেছে এবং একটি ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেতুটি ধ্বংসের কারণে নেপাল ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে। নেপালি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেনাবাহিনী ও উদ্ধারকর্মীদের দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে।

পাহাড়ি ভূপ্রকৃতির কারণে অভিযান ব্যাহত হলেও নিখোঁজদের সন্ধানে সব ধরনের চেষ্টাই চলছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এই দুর্যোগে চীনের সঙ্গে সংযোগকারী যে সেতুটি ধ্বংস হয়েছে, তা সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।