এনডিটিভি ,রয়টার্স : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ভারতীয় পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক নিয়ে বিরোধ মেটার আগে তাদের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য আলোচনা হবে না। তাঁর প্রশাসন সম্প্রতি ভারতীয় আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এ মন্তব্য করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ওভাল অফিসে দিল্লিভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, নতুন করে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর ভারতের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা আছে কি না। ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না, যতক্ষণ না আমরা বিষয়টি মেটাতে পারছি।’
হোয়াইট হাউস গত বুধবার এক নির্বাহী আদেশ জারি করে ভারতীয় পণ্যের ওপর জরিমানা হিসেবে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এর ফলে আগের ২৫ শতাংশ পাল্টাসহ মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। ট্রাম্প প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির কারণ দেখিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিশেষ করে রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির কারণে এই ২৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। ট্রাম্পের জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, এই আমদানি সরাসরি হোক বা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে হোক, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা ‘অস্বাভাবিক ও গুরুতর হুমকি’ এবং এর ফলে জরুরি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া ন্যায্য। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, প্রাথমিক ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। জরিমানা হিসেবে আরোপ করা অতিরিক্ত শুল্ক ২১ দিনের মধ্যে কার্যকর হবে। মার্কিন বন্দরে প্রবেশ করা সব ভারতীয় পণ্যের ওপর এই শুল্ক প্রযোজ্য হবে। তবে ইতিমধ্যে যাত্রাপথে থাকা পণ্য এবং কিছু ছাড়প্রাপ্ত ক্যাটাগরি বাদ থাকবে।
আদেশে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে এ পদক্ষেপ পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যেমন ভূরাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে অথবা ভারত বা অন্য কোনো দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এম এস স্বামীনাথন শতবর্ষ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁর বক্তব্যে বলেন, অর্থনৈতিক চাপে ভারত পিছু হটবে না। মোদি দাবি করেন, ‘আমাদের কাছে কৃষকের স্বার্থই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভারত কখনো কৃষক, জেলে ও দুগ্ধশিল্পের স্বার্থ নিয়ে আপস করবে না। আমি জানি, এর জন্য বড় মূল্য দিতে হবে, আর আমি প্রস্তুত। ভারত প্রস্তুত।’ ভারত বরাবরই কৃষি ও দুগ্ধশিল্পের মতো সংবেদনশীল খাত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত করতে আপত্তি জানিয়ে আসছে। কারণ, এতে গ্রামীণ জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ অচলাবস্থা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা তীব্রতর করেছে, যেখানে উভয় পক্ষই নিজেদের অর্থনৈতিক নীতি ও জাতীয় স্বার্থে অনড় অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতিতে বিপাকে পড়েছে ভারতের পোশাক রফতানিকারকরা। দেশটির তৈরি পোশাকে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা উৎপাদন ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পার্ল গ্লোবাল জানিয়েছে, গ্যাপ ও কোলসের মতো মার্কিন ক্রেতারা হঠাৎ করে মধ্যরাতে ফোন করে বলছেন, শুল্কের বোঝা ভাগ করে নিতে হবে। না হলে উৎপাদন অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও গুয়াতেমালার ১৭টি কারখানায় অর্ডার স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। পার্ল গ্লোবালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল্লব ব্যানার্জি রয়টার্সকে বলেছেন, সব ক্রেতাই ফোন করছে। তারা চাচ্ছে ভারত থেকে উৎপাদন সরিয়ে অন্য দেশে নিতে।
এপ্রিলে ট্রাম্পের প্রথম শুল্ক প্রস্তাবে ভারতের ওপর চাপ তুলনামূলক কম ছিল। তখন তা বাংলাদেশের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় ভারতের জন্য সুযোগ হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি-ওয়াশিংটনের সম্পর্কে টানাপোড়েনের পর এখন ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ এবং চীনের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ।
পার্ল গ্লোবালের অর্ধেক ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর। কিছু ক্রেতা শুল্কের খরচ ভাগাভাগি করতে চাইলেও তা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন পল্লব ব্যানার্জি। নতুন শুল্কের মধ্যে ২৫ শতাংশ বৃহস্পতিবার কার্যকর হয়েছে এবং ২৮ আগস্ট থেকে আরও ২৫ শতাংশ কার্যকর হবে। এই অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ভারতের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা ও ভারতীয় রফতানিকারকদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ উৎপাদন সরিয়ে নিচ্ছে ইথিওপিয়া বা নেপালের মতো নতুন পোশাক কেন্দ্রে। ভারতের তৈরি পোশাক খাত আগে থেকেই শ্রমিক সংকট ও উৎপাদন ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় ভুগছিল। এখন রফতানি কমে গেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মেক ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগও বড় ধাক্কা খাবে। শুধু বিদেশি কারখানাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা রক্ষা পাবে। কিন্তু দেশীয় কারখানানির্ভর রফতানিকারকেরা বড় ক্ষতির মুখে। উদাহরণ হিসেবে, রিচাকো এক্সপোর্টসের ৯৫ শতাংশ আয় আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার দিনেশ রাহেজা জানান, তারা কাঠমান্ডুতে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন।
এই সপ্তাহের শুরুতে ভারতের বৃহত্তম গয়না ও ঘড়ি প্রস্তুতকারী টাইটান জানিয়েছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে উৎপাদন সরানোর পরিকল্পনা করছে। রেমন্ডের অর্থপ্রধান অমিত আগরওয়াল জানান, ইথিওপিয়ার কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কারণ সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিতে মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক। শুল্ক আরোপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ভারতকে বিকল্প সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে দেখছিলেন। দেশটির তৈরি পোশাকের কেন্দ্র দক্ষিণ ভারতের তিরুপ্পুর এমন আশায় উজ্জীবিত ছিল। কিন্তু এখন সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
কটন ব্লসম ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক নবীন মাইকেল জন জানান, কিছু ক্রেতা অর্ডার স্থগিত করেছেন। তিরুপ্পুর এক রফতানিকারক এন. থিরুকুমারন বলেন, এক ডলারের পণ্য বা চার-পাঁচ ডলারের টি-শার্টের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক পড়লে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। নতুন শুল্ক কাঠামো কার্যকর হলে ভারতের পোশাক রফতানি খাত থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।