বিবিসি, রয়টার্স: পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষের প্রধান খাবার ভাত। ধান থেকে হয় চাল, চাল থেকে ভাত। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভবত চালে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পৃথিবী দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে চালে আর্সেনিক দূষণও বাড়ছে বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
চালে আর্সেনিকের উপস্থিতি নতুন সমস্যা নয়। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা চালে বিষাক্ত এই রাসায়নিকের উপস্থিতি কমানোর উপায় খুঁজে পেতে কাজ করছেন। প্রায় সব চালেই আর্সেনিক থাকে। আর্সেনিক একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক। মাটি, পানি, বায়ু—সব জায়গাতেই আর্সেনিক থাকে। এটি মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ধান চাষ করার সময় জমিতে আর্সেনিক জমা হয় এবং গাছের মাধ্যমে মাটি থেকে আর্সেনিক চালে প্রবেশ করে। তবে প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়ায় চালে যে পরিমাণ আর্সেনিক প্রবেশ করে, তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে অনেক কম। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে খাবার বা পানির মাধ্যমে যদি অজৈব আর্সেনিক মানবদেহে প্রবেশ করে, তবে তা ক্যানসারসহ অন্যান্য অনেক প্রাণঘাতী রোগের কারণ হতে পারে।
গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, তারা চালে যে মাত্রায় আর্সেনিক দূষণ বেড়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ শুধু চীনেই বাড়তি আরও প্রায় ১ কোটি ৯৩ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন।
চাল থেকে আর্সেনিকের মাত্রা কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। রান্নার সময় চাল থেকে আর্সেনিক কীভাবে বের করে ফেলা যায়, সেটা নিয়েও কাজ চলছে। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চালে যে মাত্রায় অজৈব আর্সেনিক পাওয়া গেছে, তা উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ গবেষণার জন্য গবেষকেরা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চীনের চারটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে ২৮ প্রজাতির ধানের চাষ করেছেন। গবেষকেরা দেখেছেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়লে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে চালে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যায়। যে পরিমাণ মানুষ বর্তমানে ভাত খান, তাতে চালে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে গেলে কত মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তার একটি মডেলও দেখিয়েছেন গবেষকেরা। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, তারা চালে যে মাত্রায় আর্সেনিক দূষণ বেড়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ শুধু চীনেই বাড়তি আরও প্রায় ১ কোটি ৯৩ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন।
ফুসফুসের জটিলতা ও হৃদরোগও বাড়বে বলে জানিয়েছেন গবেষকদের একজন লুইস জিসকা। তিনি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক। অধ্যাপক জিসকা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দুটি কারণ—বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। এর প্রভাবে আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়ছে। যদিও গবেষকেরা চীনকে গুরুত্ব দিয়ে এই গবেষণা করেছেন। তবে তারা বলেছেন, ইউরোপ–যুক্তরাষ্ট্রসহ চাল উৎপাদনকারী অন্যান্য অঞ্চলেও সম্ভবত একই প্রভাব দেখা যাবে। কারণ, বিশ্বের সব অঞ্চলেই চালে অজৈব আর্সেনিক কমবেশি পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন, রান্নার সময় কিছু নিয়ম অনুসরণ করে লাল চাল থেকে ৫০ শতাংশ এবং সাদা চাল থেকে ৭৪ শতাংশ আর্সেনিক দূর করা সম্ভব। অধ্যাপক জিসকা বলেছেন, ‘এমন নয় যে আমরাই প্রথম কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ে কাজ করছি, এমনটাও নয় যে আমরাই প্রথম বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করছি। তবে আমরাই প্রথম কেউ, যারা এই দুটি বিষয়কে মাঠে একত্র করেছি এবং এটাই আমাদের হতবাক করেছে।’
এ গবেষণায় গবেষকেরা নানা হিসাব করে ২০৫০ সালের পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা দেখিয়েছেন। অধ্যাপক জিসকা স্বীকার করেছেন, এটি ছাড়াও এ গবেষণায় আরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন গবেষকেরা ধরে নিয়েছেন, একজন ব্যক্তি ২০২১ সালে যে পরিমাণ ভাত খেয়েছেন ২০৫০ সালে গিয়েও একই পরিমাণ ভাত খাবেন। যদিও সাধারণত একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের জনগণের মধ্যে ভাত খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
এর বাইরে আরও একটি বিষয় অনুমান করে নিয়েছেন গবেষকেরা। বর্তমানে মানুষ লাল চালের পরিবর্তে সাদ চালের ভাত বেশি খান। ২০৫০ সালেও এই প্রবণতা থাকবে বলে ধরে নিয়েছেন গবেষকেরা। গবেষকেরা পরামর্শ দিয়েছেন, প্রথমে আগে থেকে গরম করা পানিতে চাল পাঁচ মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর সেই পানি ফেলে দিয়ে চালে নতুন করে পানি দিয়ে অল্প জ্বালে রেখে পানি পুরোটা শুকিয়ে ফেলতে হবে।
যেভাবে ধান উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তাতে লাল চালের চেয়ে সাদা চালে অজৈব আর্সেনিকের পরিমাণ কম থাকে। যদিও লাল চালের চেয়ে সাদা চালে পুষ্টিও কম। এখন মানুষ যদি লাল চালের ভাত খাওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে, তবে গবেষকেরা যেমনটা বলেছেন, পরিস্থিতি তার চেয়ে খারাপ হতে পারে।
এত সব সীমাবদ্ধতার পরও গবেষণাটি এ বিষয়ের ওপর এখন পর্যন্ত হওয়া ‘সবচেয়ে বিস্তারিত গবেষণাগুলোর একটি’ বলে উল্লেখ করেছেন চাল ও আর্সেনিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা অধ্যাপক অ্যান্ড্রু মেহার্গ।
কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্টের এই অধ্যাপক বলেন, এটা এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে পাওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী গবেষণা। অবশ্য তিনি এ গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কয়েক শ বছর আগে থেকেই মানুষ জানে, আর্সেনিক কতা বিষাক্ত। এটি একটি স্বাদ–বর্ণ–গন্ধহীন প্রাকৃতিক রাসায়নিক উপাদান। সেই প্রাচীন রোমান ও মধ্যযুগীয় ইউরোপে শত্রুকে দমনে আর্সেনিকের ব্যবহার দেখা গেছে। কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জীবনভর কেউ আর্সেনিকের সংস্পর্শে থাকলে, এমনকি খুবই স্বল্পমাত্রার আর্সেনিকও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে অজৈব আর্সেনিকের বেলায় এটি নিদারুণ এক সত্য। অজৈব আর্সেনিক খুব সহজে মানবদেহের জৈব অণুতে মিশে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।
পাথর ও মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে অজৈব আর্সেনিক থাকে। তবে মানবসৃষ্ট কারণ, যেমন খনি, কয়লা পোড়ানো অথবা কলকারখানা থেকেও অজৈব আর্সেনিক প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার অনেক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি পান থেকে মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার হয়।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও মানুষ বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি পান করে। সারা বিশ্বে ১৪ কোটির বেশি মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া গাইডলাইনের চেয়ে বেশি মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। পানি পান ছাড়াও বিশ্বজুড়ে মানুষের আর্সেনিক দূষণের শিকার হওয়ার একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে চাল। বিশেষ করে ইউরোপের মতো অঞ্চল যেখানে ভূগর্ভস্থ পানিতে খুব সামান্য আর্সেনিক থাকে, সেখানে মানবদেহে অজৈব আর্সেনিক প্রবেশের সব বড় কারণ চাল।