অধিকৃত পশ্চিম তীরে মসজিদে অবৈধ ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীদের আগুন দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। ওই অঞ্চলে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মাত্রা অনবরত বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যেই আগুন দেওয়ার এ ঘটনা ঘটেছে। বাসিন্দারা আলÑজাজিরাকে বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীরা পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সালফিত এলাকার কাছে দেইর ইস্তিয়া গ্রামের হাজ্জা হামিদা মসজিদে আগুন দেন। ঘটনাস্থল থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, মসজিদের দেয়ালে স্প্রে ব্যবহার করে বর্ণবিদ্বেষী ও ফিলিস্তিনবিরোধী স্লোগান লেখা হয়েছে। আগুনে মসজিদের ভেতরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের কিছু কপিও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফিলিস্তিনের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ ঘটনাকে ‘জঘন্য অপরাধ’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে। বলেছে, এর মধ্য দিয়ে অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডটিতে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত জায়গাগুলোতেও ইসরাইলী বর্বরতার কথা সামনে এসেছে। ওই ঘটনার বাইরে পশ্চিম তীরের দক্ষিণে হেবরনের কাছে বেইত উম্মার শহরে গতকাল এক অভিযানের সময় ইসরাইলী বাহিনী গুলী চালালে দুই ফিলিস্তিনী শিশু নিহত হয়।

এসব সহিংসতার ঘটনা এমন সময়ে ঘটেছে, যখন কিনা চলতি বছর পশ্চিম তীরজুড়ে ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারী ও সেনাদের হামলার সংখ্যা রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। এসব হামলার বড় অংশই ঘটছে ২০২৫ সালের জলপাই চাষের মৌসুমকে ঘিরে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা (ওসিএইচএ) তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, গত ১ অক্টোবর থেকে জলপাই চাষকে কেন্দ্র করে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের চালানো কমপক্ষে ১৬৭টি হামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এসব হামলায় ১৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনী আহত ও ৫ হাজার ৭০০টির বেশি গাছ নষ্ট হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের যুদ্ধের আড়ালে পশ্চিম তীরেও ইসরাইলী হামলা বেড়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলী হামলায় ৬৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনার বাইরে পশ্চিম তীরের দক্ষিণে হেবরনের কাছে বেইত উম্মার শহরে গতকাল এক অভিযানের সময় ইসরাইলী বাহিনী গুলী চালালে দুই ফিলিস্তিনী শিশু নিহত হয়। ইতিমধ্যে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উগ্র দক্ষিণপন্থী সরকারের সদস্যরা পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেশের অন্তর্ভুক্ত করতে চাপ দিচ্ছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরাইল এখনই পশ্চিম তীরকে কার্যত নিজেদের অংশ বলে বিবেচনা করছে এবং বর্ণবিদ্বেষী আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর গত জুলাই মাসে সতর্ক করে বলেছিল, ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনীর ‘মৌন সম্মতি, সমর্থন ও কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের’ মাধ্যমে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীরা সহিংসতা চালাচ্ছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর আরও বলেছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরকে আরও ব্যাপকভাবে দখল করার জন্য ইসরাইলের বৃহত্তর ও সমন্বিত কৌশলের অংশ হিসেবে বসতি স্থাপনকারীরা ও সামরিক বাহিনী এ হামলাগুলো চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে সেখানে ফিলিস্তিনীদের ওপর বৈষম্য, দমন পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে আরও জারাল করা হচ্ছে।

‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’

দইর ইস্তিয়ার মসজিদে গত বৃহস্পতিবারের হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, জাতিসংঘ এ ঘটনাটি নিয়ে ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ব্রিফিংয়ে স্টিফেন ডুজারিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপাসনালয়ে এমন হামলা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।’ ডুজারিক আরও বলেন, ‘আমরা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনী ও তাঁদের সম্পদের ওপর ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীদের চালানো হামলার নিন্দা জানিয়েছি এবং জানিয়ে যাব। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরাইলের উচিত বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং মসজিদে হামলা ও দেয়ালে স্প্রে করে নোংরা কথা লেখার মতা ঘটনাগুলোয় দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা।’

ফিলিস্তিনী বার্তা সংস্থা বলছে, জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়েছে। জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ সহিংসতাকে ইসরাইল সরকারের উগ্র নীতি ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্যের ধারাবাহিকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও উগ্রতা উসকে দিচ্ছে। গাজায় যুদ্ধের পরও ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সমালোচনার মুখে থাকা জার্মানিও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

একইভাবে সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম তীরে ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীদের অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো ‘অগ্রহণযোগ্য’। এক বিবৃতিতে দেশটি আরও বলেছে, এ ধরনের সহিংসতা এবং অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনীরা বিশ্বনেতাদের শুধু নিন্দা নয়, বরং দখলকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় চলমান সহিংসতার মধ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করাসহ আরও কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি।

গাজায় ধ্বংস প্রায় ৩ লাখ বাড়ি তাঁবুতেই শীত কাটাচ্ছেন ফিলিস্তিনীরা

দুই বছরের ইসরাইলী আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের গাজায় ২ লাখ ৮২ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। ফলে শীত আসার আগেই তাঁবুতে ঠাঁই নিয়েছেন লাখো মানুষ। আর ইসরাইলের অব্যাহত হামলায় যুদ্ধবিরতিও কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ইউএনআরডব্লিউএ বলছে, শেল্টার ক্লাস্টার নামে একটি মানবিক প্ল্যাটফর্ম থেকে এই হিসাব পাওয়া গেছে। সংস্থাটি ইউএনআরডব্লিউএ এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া বিবৃতিতে ইউএনআরডব্লিউএ এসব তথ্য জানায়। ইউএনআরডব্লিউএ আরও জানায়, শীত আসার আগে থেকেই লাখ লাখ ফিলিস্তিনী পরিবার তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছে। তারা অত্যন্ত সংকীর্ণ জায়গায় গাদাগাদি অবস্থায় থাকছে এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় সমস্যার মুখে পড়ার পাশাপাশি মৌলিক নানা বিষয়ও নিশ্চিত করতে লড়তে হচ্ছে তাদের।

প্রসঙ্গত, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে গত ১০ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ইসরাইল প্রতিদিনই এই সমঝোতা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। যার ফলে শত শত ফিলিস্তিনী হতাহত হচ্ছেন এবং খাবার ও চিকিৎসাসামগ্রী গাজার ভেতরে প্রবেশেও বাধা তৈরি হচ্ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলের হামলায় ৬৯ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৭০ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ। লাগাতার ধ্বংসযজ্ঞে গাজা উপত্যকা এখন বাসযোগ্যতাই হারিয়েছে।