সিএনএন, আল-জাজিরা : যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চলছে। তবে এ উপত্যকার দক্ষিণের শহর রাফাহর ‘ধ্বংসস্তূপের’ নিচে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।

যুদ্ধবিরতির প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রাফাহর বিভিন্ন সুড়ঙ্গে আটকা পড়ে আছেন অনেক হামাস যোদ্ধা। সুড়ঙ্গের ভেতরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা কক্ষে অবস্থান করছেন তাঁরা।

কোনোভাবেই যাতে গাজা যুদ্ধবিরতি ভেঙে না পড়ে, সে জন্য একটি স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন মধ্যস্থতাকারীরা। কিন্তু সুড়ঙ্গে আটকা পড়া হামাস যোদ্ধাদের বিষয়টি এ প্রচেষ্টাকে জটিলতার মুখে ঠেলে দিয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পর গাজা মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদস্যদের সরে যাওয়ার জন্য নির্ধারিত সীমারেখা ‘ইয়েলো লাইন’–এর পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলো ইসরাইলের দখলে। রাফাহও এ অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর পশ্চিমে হামাস আবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে।

যুদ্ধবিরতির পর গাজা মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদস্যদের প্রত্যাহারের জন্য নির্ধারিত সীমারেখা ‘ইয়েলো লাইন’–এর পূর্ব দিকের এলাকাগুলো এখনো ইসরাইলের দখলে। রাফাহও এ অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর পশ্চিমে হামাস আবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে।

গাজার ইসরাইল-নিয়ন্ত্রিত অংশে আটকে থাকা প্রায় ২০০ হামাস যোদ্ধার ভবিষ্যৎ কী হবে—এ প্রশ্ন এখন আর শুধু সামরিক হিসাব-নিকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি পরিণত হয়েছে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক সংকটে। এর সুস্পষ্ট কোনো সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক মাস পরও সুড়ঙ্গের ছোট ছোট কক্ষের সঠিক সংখ্যা বা অবস্থান নির্ধারণ করা যায়নি। এ সময়ে হামাস যোদ্ধারা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলো নিজেদের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত করেছেন।

রাফাহতে দুই ইসরাইলি সেনা নিহত হওয়ার পর গত ১৯ অক্টোবর ইসরাইল সেখানে ভয়াবহ হামলা চালায়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৪৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর ওই এলাকায় আরও এক ইসরাইলি সেনা নিহত হন। ইসরাইল পাল্টা হামলা চালায়। নিহত হন শতাধিক ফিলিস্তিনি।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি সুড়ঙ্গগুলো থেকে হামাস যোদ্ধাদের বের হওয়ার কিংবা হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবেন না। অন্যদিকে হামাস বলেছে, তাদের যোদ্ধারা কখনো আত্মসমর্পণ করবেন না কিংবা অস্ত্রও জমা দেবেন না।

দুই ইসরাইলি সূত্র জানায়, ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলকে কার্যকর সমাধানের দিকে এগোতে চাপ দিচ্ছে। মার্কিন দূত ও ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারও চলতি সপ্তাহে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটি সূত্র বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের দিকে এগোতে চায়।

যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে গাজায় একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন, হামাসকে নিরস্ত্র করা ও আরও ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিটি বিষয়েই একাধিক দেশের সঙ্গে বড় পরিসরে আলোচনা করা প্রয়োজন। গাজার সুড়ঙ্গে বেশ কিছু হামাস যোদ্ধার আটকে থাকার বিষয়টি এ জটিল কূটনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

আরেকটি সূত্র বলেছে, একপর্যায়ে এ যোদ্ধাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটেনি।

নেতানিয়াহুর কার্যালয় রাফাহর ‘বন্দী’দের মুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন খবর বারবার অস্বীকার করেছে। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে বন্দী মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেননি। এ–সংক্রান্ত কোনো সমঝোতাও হয়নি।’

এর আগে ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের গাজা বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ শেহাদা বলেছিলেন, কোনো সমাধান না হওয়ায় সুড়ঙ্গের এ কক্ষগুলো বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকা টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। হামাস যোদ্ধাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ও পানি নেই। ফলে তাঁদের জন্য মাত্র দুটি পথ খোলা আছে। হয় লড়াই করা, নয়তো আত্মসমর্পণ। হামাস যোদ্ধারা নিজেরাই জানেন না, সুড়ঙ্গগুলোয় এখন কতজন জীবিত আছেন।

বিষয়টি যুদ্ধবিরতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হামাসের কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ সুড়ঙ্গ কক্ষগুলো ইসরাইলি বাহিনীর ওপর সাম্প্রতিক হামলার জন্য দায়ী। প্রতিশোধ নিতে ইসরাইল পাল্টা হামলা করেছে। ফলে দুবার যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়।

রাফাহতে দুই ইসরাইলি সেনা নিহত হওয়ার পর গত ১৯ অক্টোবর ইসরাইল সেখানে ভয়াবহ হামলা চালায়। এ হামলায় কমপক্ষে ৪৪ ফিলিস্তিনি নিহত হন। প্রায় এক সপ্তাহ পর ওই এলাকায় আরও এক ইসরাইলি সেনা নিহত হন। ইসরাইল পাল্টা হামলা চালায়। নিহত হন শতাধিক ফিলিস্তিনি।

ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ভূগর্ভস্থ এসব কক্ষে অভিযান চালাচ্ছে। গত বুধবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার আইডিএফ জানায়, তারা ‘ভূগর্ভস্থ অবকাঠামো ধ্বংসের’ অভিযানে গিয়ে ইসরাইল-অধিকৃত এলাকায় ‘চারজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে’ শনাক্ত করে ও গুলি চালায়।

গাজা যুদ্ধবিরতির প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মাঝামাঝি এসে কূটনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ইসরাইল বা হামাস—কেউই নিজেদের অবস্থান বদলাতে রাজি নয়।

গত রোববার হামাসের সামরিক শাখা আল কাসাম ব্রিগেড এক বিবৃতিতে বলেছে, শত্রুর কাছে ঘেরাও হওয়া বা আত্মসমর্পণ বলে কোনো শব্দ তাদের কাছে নেই। যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে মধ্যস্থতাকারীদেরই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

এরই মধ্যে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ভূগর্ভস্থ এসব কক্ষে অভিযান চালাচ্ছে। গত বুধবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার আইডিএফ জানায়, তারা ‘ভূগর্ভস্থ অবকাঠামো ধ্বংসের’ অভিযানে গিয়ে ইসরাইল-অধিকৃত এলাকায় ‘চারজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে’ শনাক্ত করে ও গুলি চালায়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, এসব অভিযান যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। চুক্তিতে গাজার সামরিক ও সুড়ঙ্গ অবকাঠামো ধ্বংসের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু হামাসের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

নেতানিয়াহু এরই মধ্যে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের মুখে রয়েছেন। কেউ চাইছেন না এমন কোনো চুক্তি হোক, যা সুড়ঙ্গে থাকা হামাস যোদ্ধাদের নিরাপদে হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবে।

ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান বলেছেন, ‘যারা যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলি সেনাদের হত্যা করেছেন, তাঁদের জন্য দুটি পথই খোলা আছে—আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যাওয়া অথবা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া।’

এমন রাজনৈতিক চাপের ফলে গ্রহণযোগ্য সমাধান খোঁজার বাস্তবসম্মত পথ নেতানিয়াহুর জন্য সীমিত হয়ে যাচ্ছে। কারণ, কিছুটা ছাড় দিলেই তিনি সমালোচনার মুখে পড়বেন। বলা হতে পারে যে তিনি হামাসের কাছে নতি স্বীকার করেছেন।

মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী, হামাসের এসব যোদ্ধা অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিলে তাঁদের সাধারণ ক্ষমা করা যেতে পারে।

সুড়ঙ্গে অবস্থানরত হামাস যোদ্ধাদের বিষয়টি হয়তো পুরো যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেবে না। তবে মধ্যস্থতাকারীদের জন্য এটি একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ বাধা অতিক্রম করেই তাদের যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে হবে।

এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলি বাহিনী চালানো সবশেষ হামলায় অন্তত তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। একই সঙ্গে টানা ভারি বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে গাজার হাজারো অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।

গত রোববার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমকে নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের এক সূত্র জানায়, দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসের পূর্বদিকে ইসরাইলি বোমা হামলায় তিনজন নিহত হন। একই দিনে ইসরাইলি বাহিনী গাজা সিটির জেইতুন এলাকার পাশাপাশি রাফাহের নিকটবর্তী কিছু এলাকায়ও হামলা চালায়।

গাজা সিটি থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক ইব্রাহিম আল-খালিলি জানান, যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইসরাইলি সেনারা যে ‘ইয়োলো লাইন’-এর পেছনে সরে গেছে বলে দাবি করে, সেই লাইনের আশপাশেও তারা নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ইয়োলো লাইন’র কাছে থাকা পরিবারগুলোর পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী এখনো আবাসিক ভবন ধ্বংস করছে এবং আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, এদিকে প্রবল বৃষ্টিতে তাদের অস্থায়ী আশ্রয় প্লাবিত হচ্ছে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, গাজায় গত দুই বছরের নির্বিচার বোমাবর্ষণে যাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে এমন প্রায় ১৩ হাজার পরিবার এখন তীব্র ঠান্ডা ও বন্যার মধ্যে অত্যন্ত দুর্বল ও অপ্রতুল আশ্রয়ে দিন কাটাচ্ছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার মোট ভবন ও আবাসিক ইউনিটের ৮০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল এখনো গাজায় তাঁবু ও মোবাইল হোমসহ জরুরি আশ্রয়সামগ্রী প্রবেশে বাধা দিচ্ছে—যা সংকটগ্রস্ত মানুষের ভোগান্তিকে আরও গভীর করছে।