আল জাজিরা, এক্সে,এপি, এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি : গাজায় আসলেই অনাহার চলছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত সোমবার স্কটল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, ‘ওখানে কেউই কোনো ভালো কাজ করেনি। পুরো এলাকা জগাখিচুড়ি।’ এর আগের দিন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছিলেন, ‘গাজায় কোনও অনাহার নেই’। স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘কিছুদিন আগে টেলিভিশন সংবাদে আমি গাজার একদল শিশুকে দেখলাম। তাদের খুবই ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছিল। গাজায় সত্যিকারের ক্ষুধা সংকট শুরু হয়েছে এবং আপনি একে কোনোভাবেই ভুয়া বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না।’ গাজায় মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি বলতে চাইছি, ওই বাচ্চারা সত্যিই ক্ষুধার্ত। আমি চাই সে (নেতানিয়াহু) নিশ্চিত করুক যে, তারা খাবার পাচ্ছে। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, তারা খাবার পাচ্ছে।’ সংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ‘খাদ্য কেন্দ্র’ স্থাপন করবে জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা গাজায় খাদ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছি, যেখানে লোকেরা প্রবেশ করতে পারবে এবং কোনো সীমানা থাকবে না, আমরা বেড়া দেব না। আমরা কিছু খুব ভালো মানুষের সঙ্গে মিলে এটি করব। আমরা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছি, আমরা প্রচুর অর্থ পেয়েছি এবং অন্যান্য দেশগুলো আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্র যে ‘খাদ্য কেন্দ্র’ স্থাপনের পরিকল্পনা করছে সেগুলো পরিচালনার দায়িত্বে কে থাকবেÍ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য বিতরণের জন্য সাহায্য করবে এবং আমরা নিশ্চিত করব সেখানে যেন কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়, মানুষ যাতে আটকে না থাকে।’ ট্রাম্পের এই মন্তব্য আসে এমন এক সময়ে, যখন জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, গাজায় অনাহার ঠেকাতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ যেমন বিমান থেকে খাদ্য সহায়তা ফেলা এবং সামরিক বিরতির মাধ্যমে খাদ্য কনভয় পৌঁছাতে দেওয়া স্বাগতযোগ্য, কিন্তু এখনো যা সরবরাহ হয়েছে, তা একেবারে ‘সাগরে এক ফোঁটা’। তিনি বলেন, “এটা একটা শুরু মাত্র, কিন্তু সামনের কয়েকদিন সত্যিই নির্ধারণমূলক। আমাদের অনেক বড় পরিসরে সহায়তা পাঠাতে হবে, অনেক দ্রুত গতিতে।” রবিবার ইসরায়েল জানায়, ১০ ঘণ্টার একটি সাময়িক "কৌশলগত বিরতি" চলাকালে ১২০টি ট্রাক সহায়তা সীমান্ত পার হয়েছে এবং জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিমান থেকে ২৮টি খাদ্য প্যাকেজ ফেলেছে।
কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই হামাস-শাসিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় অপুষ্টির কারণে আরও ১৪ জন মারা গেছে। এ নিয়ে অক্টোবর ২০২৩-এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৪৭ জনে, যার মধ্যে ৮৮ জনই শিশু। ইসরায়েল, যাদের হাতে গাজার সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ, অনাহার বা খাদ্য সংকটের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এই পরিস্থিতির জন্য দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নেতানিয়াহু রবিবার বলেন, গাজায় ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ মানুষকে অনাহারে রাখার অভিযোগ একটি স্পষ্ট মিথ্যা, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অথচ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোকে গাজায় স্বাধীনভাবে প্রবেশ করতে দেয় না, যার ফলে বাস্তব পরিস্থিতির নিরপেক্ষ যাচাই কঠিন।
অনাহারে মৃত্যু বাড়ছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) রোববার বলেছে, এ মাসে গাজায় অনাহারে ভুগে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪ শিশু রয়েছে। এ বছরের প্রথম ৬ মাসে উপত্যকাটিতে অনাহারে ১১ জন মারা গেছেন। সে তুলনায় এক মাসে ৬৩ জনের মৃত্যু উদ্বেগজনক রকম বেশি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, এ মাসে গাজায় অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগে ৮২ জন মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ২৪টি শিশু ও ৫৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত রোববার বলেছে, এ মাসে গাজায় অনাহারে ভুগে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪ শিশু রয়েছে। এ বছরের প্রথম ৬ মাসে উপত্যকাটিতে অনাহারে ১১ জন মারা গেছেন। সে তুলনায় এক মাসে ৬৩ জনের মৃত্যু উদ্বেগজনক রকম বেশি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আরও বলা হয়, বিগত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সেখানে যুদ্ধের মধ্যে হতাহতের প্রকৃত তথ্য পাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস বলে বিবেচনা করে জাতিসংঘ। দ্য পেশেন্টস ফ্রেন্ডস হাসপাতাল গাজার উত্তরাঞ্চলে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য প্রধান জরুরি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। হাসপাতালটি থেকে বলা হয়েছে, এ মাসে তারা প্রথমবারের মতো অনাহারে এমন শিশুদের মৃত্যু দেখছে, যারা আগে অসুস্থ ছিল না।
আমরা ভিক্ষা নই ॥ অধিকার চাই: বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে ত্রাণ ফেলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন গাজাবাসী ফিলিস্তিনিরা। তারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই সহায়তা পদ্ধতি তাদের মর্যাদাহানি করছে। গাজায় আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলার প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা আহমেদ ফায়েজ ফায়াদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা কুকুর নই যে খাবারের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব বা এক টুকরো রুটির জন্য লড়াই করব। আমরা মানুষের মতো মর্যাদার সাথে বাঁচার অধিকার চাই।’ অন্য একজন ফিলিস্তিনি মা, যিনি তিন দিন ধরে তার পরিবারের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, বলেন, ‘আমার শিশু ক্ষুধায় কাঁদে, আর আমাকে এই অপমান সহ্য করতে হয়? সাহায্য নয়, আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই।’ বিমান থেকে ফেলা বেশিরভাগ সহায়তা সমুদ্র বা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় পড়ছে, যা সংগ্রহ করা বিপজ্জনক। এছাড়াও অনেক সময় সহায়তার প্যাকেট মাটিতে পড়ে ভেঙে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্থলপথে সহায়তা বিতরণের পরিবর্তে এই পদ্ধতিকে ‘প্রদর্শনীমূলক’ বলে মনে করছেন অনেক ফিলিস্তিনি। এদিকে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করে বলেছে, এই ধরনের সহায়তা পদ্ধতি গাজার বাসিন্দাদের মানসিক আঘাত দিচ্ছে।
জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটি কোনো সমাধান নয়। গাজার প্রতিটি পরিবারের দোরগোড়ায় পর্যাপ্ত সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হলো অবরোধ প্রত্যাহার।’ এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জোর দাবি উঠছে। গাজার একজন শিক্ষক বলেছেন, ‘আমরা ভিক্ষুক নই। আমরা শুধু আমাদের অধিকার চাই – নিরাপদ জীবন ও মর্যাদার সাথে বাঁচার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন প্রশ্ন: তারা কি শুধু খাদ্য ফেলবে, নাকি ফিলিস্তিনিদের মর্যাদার অধিকারকেও সমর্থন করবে?’