ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হামলায় এক রাতেই নিহত হয়েছেন চার শতাধিক ফিলিস্তিনি। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে চালানো বর্বর এই হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের অনেকেই নারী ও শিশু। এএফপি, আনাদুলো।

এমন অবস্থায় গাজায় ইসরাইলের নারকীয় এই তাণ্ডবের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় তিনি ক্ষুব্ধ বলেও জানিয়েছেন তিনি।

একইসঙ্গে যুদ্ধবিরতি মেনে চলতেও আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের এই মহাসচিব। বুধবার (১৯ মার্চ) এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় তিনি ক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে নিজের অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে তিনি একথা বলেন।

গুতেরেস আরও বলেন, “আমি যুদ্ধবিরতি মেনে চলার, নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং আটক থাকা অবশিষ্ট বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার জন্য জোরালোভাবে আবেদন করছি।”

অবশ্য গাজায় ইসরাইলের নতুন করে বোমাবর্ষণের নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের সরকার এবং বিভিন্ন মানবিক সংস্থা। আর এই নিন্দা ও সমালোচনার মধ্যেই ইসরাইলের চালানো হামলায় গাজায় আরও এক নারী ও তার শিশু নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

গাজা থেকে আল জাজিরা আরবি বিভাগের একজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন, খান ইউনিসের পশ্চিমে একটি তাঁবুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় এক নারী ও তার শিশু নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

হামাসের এই ঘোষণা এমন সময়ে এলো যখন ইসরাইলি বাহিনী গাজায় তীব্র বিমান হামলা চালিয়ে শতশত নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুকে হত্যা করছে। যেখানে শুধু মঙ্গলবারের হামলায় ৪২৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ১৭৪ জন শিশু ও ৮৯ জন নারী।

এছাড়া ইসরাইলি হামলায় ৬০০-র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তাদেরকে বাড়িঘর, মসজিদ ও আশ্রয়স্থল লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।

অন্যদিকে ইসরাইল গত ১৭ দিন ধরে গাজার সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে রেখেছে। যার ফলে উপত্যকাজুড়ে চরম মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

ইসরাইলের নতুন করে হামলা ‘অগ্রহণযোগ্য’: ইইউ

গাজায় ইসরাইলের নতুন করে হামলা ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কালাস। মঙ্গলবার ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সা’রের সঙ্গে এক কথোপকথনে তিনি এ কথা বলেন। বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৯ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতির চুক্তির করে ইসরাইল। গত ১ মার্চ সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। নতুন করে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনায় না গিয়ে গাজায় আবারও অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। এরই জেরে মঙ্গলবার গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ইসরাইল।

হামাস-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর ইসরাইলের বোমা হামলায় দুদিনে প্রায় সাড়ে ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন কয়েকশ জন।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘এই হামলা কেবল শুরু। হামাসের সঙ্গে ভবিষ্যতে আলোচনা কেবল হামলার মাধ্যমেই হবে।’

বিশ্বব্যাপী ইসরাইল-মার্কিন দূতাবাস অবরোধের ডাক হামাসের

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বিশ্বব্যাপী ইসরাইলি ও মার্কিন দূতাবাসগুলোর সামনে অবরোধ ও ব্যাপক বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হামাস আরব ও মুসলিম বিশ্বসহ গোটাবিশ্বের মুক্ত চেতনাসম্পন্ন মানুষের প্রতি এ আহ্বান জানায়।

গাজায় চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশে এই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে সংগঠনটি।

হামাসের অভিযোগ, ‘দখলদার ফ্যাসিবাদী সরকার আবারও গাজায় বর্বর আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে, যা মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় আইন লঙ্ঘন করছে’।

এরই প্রেক্ষিতে সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ইসরাইল ও মার্কিন দূতাবাসগুলোর সামনে অবরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই অবরোধের লক্ষ্য হবে তেলআবিব ও ওয়াশিংটনের ওপর সব ধরনের চাপ সৃষ্টি করা। যাতে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে চলমান আগ্রাসন বন্ধ হয়’।

হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ

১৯ মার্চ, আনাদোলু : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ভয়াবহ হামলার প্রতিবাদে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলনকারীরা। গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। প্রতিবাদ কর্মসূচির সময় ইসরাইলে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি বন্ধ এবং গাজা-পশ্চিমতীরে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসানের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। গাজার যুদ্ধবিধ্বস্তদের প্রতি সমর্থনের চিহ্ন হিসেবে বিক্ষোভকারীদের অনেকেই কেফিয়েহ নামের ফিলিস্তিনি স্কার্ফ পরেছিলেন। তাদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডও ধরা ছিল। সেসব প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘ইসরাইলে সব ধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধ কর’, ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চাই’, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো বোমায় নিহত হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা’ প্রভৃতি বক্তব্য।

ইসরাইলি গণহত্যার নতুন অধ্যায় শুরু: তুরস্ক

১৯ মার্চ এএফপি যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় ইসরাইলের নতুন হত্যাযজ্ঞকে দেশটির ‘গণহত্যার নীতির নতুন অধ্যায়’ বলে আখ্যা দিয়েছে তুরস্ক। ফরাসি বার্তা সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার রাতে শুরু হওয়া ইসরাইলী বিমান হামলায় নিহতের সংস্থা বেড়ে ৪১৩ জনে দাঁড়িয়েছে। মঙ্গলবার তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজায় আবার ফিলিস্তিনিদের ওপর শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞ প্রমাণ করে, নেতানিয়াহু সরকারের গণহত্যা নীতি একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।’ এই হত্যাযজ্ঞকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ বলেও আখ্যা দেয়া হয় বিবৃতিতে।

১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই এটিই ইসরাইলের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। রাতভর চলা এই হামলায় হতাহতরা চিকিৎসা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। রেড ক্রসের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা জানায়, গাজার হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে হতাহতদের ভিড়ে। এর আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলা ১৬ মাসের ইসরাইলী গণহত্যায় গাজার প্রায় সব বড় হাসপাতালই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং যুদ্ধবিরতির প্রতি সম্মান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।