২৯ মার্চ, আজকের পত্রিকা : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক খড়গের আঘাতে ভারতের অর্থনীতি তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে বলে সতর্ক করেছেন দেশটির কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম। এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প যদি একসঙ্গে সব দেশকে লক্ষ্যবস্তু না করে, বরং একেকটি দেশকে বেছে নিয়ে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে সেই দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে শুধু ভারতকে বেছে নিলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। মাত্র তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই আমাদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ট্রাম্প সব দেশকে এক কাতারে এনে সর্বজনীন শুল্ক আরোপ করবেন না। প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা একটি হার নির্ধারণ করছেন। তিনি একের পর এক দেশকে লক্ষ্যবস্তু করবেন এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবেন। যদি তিনি তা করেন এবং প্রথমে ভারতকে বেছে নেন, তবে অন্যান্য দেশ বলবে, ‘আমাদের এখনো টার্গেট করা হয়নি।’ তাই যদি আমরা এই কৌশলগত টার্গেটিং রোধে পদক্ষেপ না নিই, তাহলে প্রথম হামলার পর আমরা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।’
তিনি বলেন, যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট দেশগুলোর ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপ করতে শুরু করেন, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিজেদের মতো করে এর মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতিমালা, বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথা রয়েছে। তাই যদি কেউ বিভিন্ন দেশের শুল্ক নতুন করে নির্ধারণ করতে চায়, তবে অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের হুমকির বিপরীতে ভারত সরকারের পদক্ষেপ স্পষ্ট করে জানানোর আহ্বান করেছেন এই নেতা। তাঁর দাবি, সরকারের সব মন্ত্রীও জানেন না, শুল্কের বিপরীতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম আরও বলেন, যদি ভারতের সরকার মনে করে, আমেরিকা এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে, তবে এই অবস্থার মোকাবিলায় সরকারের একটি সুস্পষ্ট নীতি থাকা উচিত।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের এসব পদক্ষেপ বিশ্বকে জানানো জরুরি নয়, তবে অন্তত সংসদে একটি বিবৃতি দেওয়া উচিত বা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। আমরা এ নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছি। আসলে, আমার জানা মতে, বেশির ভাগ মন্ত্রীও অন্ধকারে রয়েছেন। আমেরিকার অনিশ্চিত নীতির প্রতিক্রিয়ায় এই নীতি কে তৈরি করছে? আমি জানি না। মনে হচ্ছে কেউই জানে না।’
পি চিদাম্বরম বলেন, ‘আমি বলতে চাই, এটি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে পারে না। মার্কিনরাও অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে, তবে আমাদের বিকল্প পরিস্থিতিগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি তারা এক ধাপ এগিয়ে যায়, তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা ভেবে রাখতে হবে। যদি তারা দুই ধাপ পিছিয়ে যায়, তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা আগে থেকে ঠিক করে রাখতে হবে।
পি চিদাম্বরম বলেন, ‘আমার মনে হয়, সরকার তাৎক্ষণিক, একতরফা ও আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাজেট ভাষণে তারা ২ শতাংশ কর বাতিল করেছে। এরপর অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ৬ শতাংশ ডিজিটাল সার্ভিস ট্যাক্স, যা সাধারণত ‘গুগল ট্যাক্স’ নামে পরিচিত, সেটিও তুলে দেওয়া হবে। এখন ট্রাম্পকে তাঁরা আর কী কী দেবেন?’
তিনি আরও বলেন, সংসদে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে না চান, তবে অন্তত সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান বিরোধী দলগুলোর নেতাদের ডেকে নেওয়া উচিত এবং তাদের আস্থাভাজন করে জানানো উচিত যে কী কী বিকল্প পরিস্থিতি বিবেচনা করা হচ্ছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয় এই মুহূর্তে শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং হয়তো বাণিজ্যমন্ত্রী, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তাঁরাই জানেন কী হচ্ছে। আমার মনে হয় না অন্য কোনো মন্ত্রী জানেন। আমি নিশ্চিত, কৃষিমন্ত্রী এমনকি শিল্পমন্ত্রীও জানেন না। কিন্তু তাঁরা ছাড় দিচ্ছেন? আমি জানি না। আপনি কি কৃষি খাতে ছাড় দিচ্ছেন? আপনি কি শিল্পপণ্যে ছাড় দিচ্ছেন? আপনি কি মেধাস্বত্ব-সংক্রান্ত কোনো ছাড় দিচ্ছেন? আমি মনে করি না কেউ জানেন।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারতকে অবশ্যই নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে অনেক দেশ এখন একমত যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত একতরফা শুল্ক মেনে নেওয়া যাবে না।
পি চিদাম্বরম বলেন, কেউ যদি বিভিন্ন দেশের শুল্ক নতুনভাবে নির্ধারণ করতে চায়, তবে অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির কথা তুলে ধরে চিদাম্বরম বলেন, তিনি তাঁর সংসদকে আস্থায় নিয়েছেন, অন্তত নেতাদের আস্থায় নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রাম্পের একতরফা শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
চিদাম্বরম আরও বলেন, ‘এখন নিশ্চিতভাবে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যেও সমন্বয় চলছে। আমরা প্রধান কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক দেশ, প্রধান বস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। আমরা প্রচুর শিল্পপণ্যও রপ্তানি করি। তাই আমাদের উচিত কৃষি, বস্ত্র ও শিল্পপণ্য রপ্তানিকারী দেশগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে একটি সাধারণ কৌশল তৈরি করা।’
আগামী ২ এপ্রিল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। গাড়ি আমদানির ওপর ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ভারতের প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ওপর অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে। শিল্পসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এতে লাভের পরিমাণ কমে যাবে।
ভারত থেকে খুব বেশি পরিমাণে গাড়ি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয় না, তবে টাটা মোটরসের বিলাসবহুল গাড়ি সংস্থা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর) মার্কিন বাজারে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এই শুল্ক খড়্গ ভারতের অটো অ্যানসিলিয়ারি বা গাড়ির যন্ত্রাংশ শিল্পের ওপর বেশ আঘাত করবে। কারণ, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে গাড়ির যন্ত্রাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। ভারতের অটো কম্পোনেন্ট খাতের মোট আয়ের প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগ রপ্তানি থেকে আসে। এর মধ্যে ২৭ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যায়।