হারেৎজের, আল জাজিরা, রয়টার্স: ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাজুড়ে ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭২ জন নিহত হয়েছেন। গাজার বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। ২৪ ঘণ্টায় নিহত ব্যক্তিদের এ তালিকায় ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারানো মানুষেরাও আছেন। গাজা সরকারের গণমাধ্যম কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, গত চার সপ্তাহে অন্তত ৫৪৯ জন ফিলিস্তিনি ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের জিএইচএফ ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র বা এগুলোর আশপাশে আরও ৪ হাজার ৬৬ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। এতে আনুমানিক ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬ হাজার ২৫৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৮ জন। এদিকে গাজায় আটক ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে তেল আবিবে জড়ো হন তাদের পরিবার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি সরকারের প্রতি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান তারা। রাজনৈতিক স্বার্থে জিম্মিরা বলি হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলীর আদেশ দেয়ার স্বীকারোক্তি সেনাদের : ইসরাইলি সেনাসদস্য ও কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ত্রাণ নিতে আসা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে তাঁদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ত্রাণ নিতে আসা লোকজন যাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান, সে জন্য তাঁদের ওপর গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ইসরায়েলের প্রভাবশালী হারেৎজ পত্রিকা কয়েকজন সেনাসদস্য ও কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) দাবি করে আসছে, ত্রাণ নিতে এসে কেউ নিহত হননি বা তাঁদের ওপর হামলার ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। এক মাস ধরে গাজায় ত্রাণ বিতরণ করছে বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফ। জিএইচএফের এসব ত্রাণকেন্দ্র এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, ফিলিস্তিনিদের সামনে এখন দুটি পথহয় না খেয়ে মরবে, না হয় খাবার আনতে গিয়ে মারবে। জিএইচএফ নিয়ে শুরু থেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সন্দেহ প্রকাশ করছিল। কারা এই সংস্থা চালায়, কারা অর্থ দেয়, কেন চালায়Íকোনো কিছুই পরিষ্কার নয়। অনেকেই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলই এই ত্রাণ সংস্থা চালাচ্ছে, যাতে তারা ত্রাণের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখে গাজার ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়। ত্রাণকেন্দ্রে নিহত ব্যক্তিদের সবাইকে গুলি করেছেন ইসরায়েলি সেনারা। আর এই গুলি চালাতে সেনাদের সরাসরি আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে যুদ্ধাপরাধ ঘটেছে কি না, তা তদন্ত করতে সেনাবাহিনীর কৌঁসুলি অফিস ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিবেদনে ইসরায়েলি সেনাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ত্রাণ নিতে আসা মানুষ যাতে এগোতে না পারেন বা তাঁরা যেন ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান, সে জন্য তাঁদের ওপর গুলি চালিয়েছেন সেনারা। অথচ ত্রাণ নিতে আসা জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাণনাশী নয়, এমন কোনো অস্ত্র বা উপায় ব্যবহার করা হয়নি। এক ইসরায়েলি সেনা বলেন, ‘এটি যেন একটা হত্যার জায়গা। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে প্রতিদিন এক থেকে পাঁচজন মারা যেতেন।’
ওই সেনাসদস্য আরও বলেন, ‘ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর এমনভাবে গুলি চালানো হয়, যেন তাঁরা আমাদের আক্রমণ করছেন। আমরা দাঙ্গা দমন করার অস্ত্র ব্যবহার করি না, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ি না। আমরা শুধু ভারী মেশিনগান থেকে গুলি করি, গ্রেনেড বা মর্টার ছুড়ি।’ ওই ইসরায়েলি সেনা আরও যোগ করেন, ‘আমরা ওদের সঙ্গে কথা বলি গুলির মাধ্যমে।’
এমন পরিস্থিতিতেও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফের জন্য তিন কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে। অথচ ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। মানবাধিকার আইনজীবীরা সতর্ক করেছেন, এই সংস্থার কর্মীরা যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।