বিবিসি ,রয়টার্স: ভোরে সূর্য ওঠার সময় বেদুইন গাইডের সঙ্গে সিনাই পর্বতের খাড়া পাথুরে পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেক ভ্রমণকারীই মনে রেখেছেন। সেখানে ছিল প্রার্থনার নীরবতা, প্রাচীন কাহিনি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আকাশছোঁয়া শিলা সব মিলিয়ে জায়গাটি যেন অন্য কোনো ভুবন। মিসরের অন্যতম এই পবিত্র স্থান ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিমরা সমানভাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন। সেই সিনাই এবার বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, মুছে যাচ্ছে বহু প্রজন্ম ধরে থাকা মানুষের জীবনযাত্রা। এখানে নির্মিত হচ্ছে বিলাসবহুল হোটেল, ভিলা ও শপিং সেন্টার। সিনাই পবর্তের এ স্থানে একটি নতুন পর্যটন মেগা প্রকল্পে রূপান্তরের পরিকল্পনা ঘিরে তুমুল বিতর্কও চলছে।

স্থানীয়ভাবে সিনাই পর্বত জাবাল মূসা নামে পরিচিত। পবিত্র কোরআন ও বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, এখানে নবী মুসা (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে ১০টি আদেশ পেয়েছিলেন। অনেকের বিশ্বাস, এখানেই পবিত্র কোরআন ও বাইবেল অনুযায়ী এখানেই আল্লাহ মুসা (আ.)-এর সঙ্গে জ্বলন্ত ঝোপের মধ্য থেকে কথা বলেছিলেন। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিষ্টান মঠগুলোর একটি হলো ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত সেন্ট ক্যাথরিন মঠ। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের অধীন পরিচালিত এই মঠও এখানে অবস্থিত। গ্রিসের চাপের কারণে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ এই মঠটি বন্ধ করার কথা অস্বীকার করেছে। তাই মঠের সন্ন্যাসীরা এখনো সেখানে অবস্থান করছেন। দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন এই মরুভূমি অঞ্চল যা মঠ, শহর ও পর্বত নিয়ে গঠিত ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, তা বদলে যাচ্ছে। সেখানে এখন বিলাসবহুল হোটেল, ভিলা ও শপিং মল নির্মিত হচ্ছে। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

বেদুইনদের কান্না : এ অঞ্চলে জেবেলিয়া নামের একটি ঐহিত্যবাহী বেদুইন জনগোষ্ঠীর বাস। প্রাচীনকাল থেকে তারা সেন্ট ক্যাথরিনের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত। এই জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি এবং পর্যটন ইকো-ক্যাম্পগুলো প্রায় ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া পার্কিংয়ের জায়গা করার জন্য স্থানীয় কবরস্থান থেকে মৃতদেহ সরাতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। ব্রিটিশ ভ্রমণ লেখক বেন হফলার সিনাই উপজাতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, প্রকল্পটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টেকসই উন্নয়ন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি পর্যটনকে আরও উৎসাহিত করবে ঠিকই। তবে এটি বেদুইনদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেন হফলার বলেন, জেবেলিয়ারা যে রকম চেয়েছিল, এটি ঠিক সে রকম কোনো উন্নয়ন নয়। বাইরের মানুষের স্বার্থরক্ষার জন্য এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি পরিকল্পনা। এই ভ্রমণ লেখক আরও বলেন, ‘যাযাবর ঐতিহ্যের বেদুইন উপজাতির চারপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে এক নতুন নগরসভ্যতা। এটি এমন একটি নগর, যা থেকে তারা সব সময় বিচ্ছিন্ন থেকেছে, যা নির্মাণে তারা কোনো সম্মতি দেয়নি। এ ছাড়া এটি মাতৃভূমিতে তাদের অবস্থান চিরতরে বদলে দেবে।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের নীরবতা: এই অঞ্চলে প্রায় চার হাজার বেদুইন বাস করে। তাদের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেছে। এই পরিবর্তন নিয়ে তারা কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। এ পর্যন্ত গ্রিস হলো একমাত্র বিদেশি শক্তি, যারা এই মিসরীয় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব। কারণ, এখানকার মঠের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পর্ক আছে। গত মে মাসে মিসরের একটি আদালত বিশ্বের প্রাচীনতম ও বহুল ব্যবহৃত খ্রিষ্টান মঠ সেন্ট ক্যাথেরিনসকে রাষ্ট্রীয় জমিতে অবস্থিত বলে রায় দেওয়ার পর এথেন্স ও কায়রোর মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। কয়েক দশক ধরে চলা বিরোধের পর বিচারকেরা বলেন, মঠটি শুধু এর জমি ও আশপাশের প্রত্নতাত্ত্বিক ধর্মীয় স্থানগুলো ‘ব্যবহারের অধিকার’ রাখে। গ্রিসের চার্চপ্রধান আর্চবিশপ দ্বিতীয় ইয়েরোনিমোস দ্বিতীয় এই রায়ের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মঠের সম্পত্তি দখল ও বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। অর্থোডক্স ও হেলেনিজমের এই আধ্যাত্মিক বাতিঘর এখন অস্তিত্ব–সংকটের মুখে।

দীর্ঘদিন আর্চবিশপের দায়িত্ব পালন করা দামিয়ানোস গ্রিক সংবাদপত্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ সিদ্ধান্ত ‘আমাদের জন্য মারাত্মক আঘাত...এবং এক লজ্জাজনক ঘটনা।’ বিষয়টি সামলাতে গিয়ে যাজকদের ভেতরে বিভাজন তৈরি হয়েছে। এ কারণে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন বলেও জানিয়েছেন। আদালতের বিতর্কিত রায় বহাল থাকলেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর গ্রিস ও মিসর একটি যৌথ ঘোষণায় সেন্ট ক্যাথরিনের গ্রিক অর্থোডক্স পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

উন্নয়ন, নাকি ধ্বংস: মিসর সরকার ২০২১ সালে গ্রেট ট্রান্সফিগারেশন নামের এই প্রকল্প শুরু করে। পর্যটকদের জন্য করা এই পরিকল্পনার মধ্যে আছে হোটেল, ইকো লজ ও একটি বৃহৎ দর্শনার্থীকেন্দ্র খোলার পাশাপাশি কাছাকাছি ছোট বিমানবন্দর ও মাউন্ট মোজেসা পর্যন্ত একটি কেব্ল কার স্থাপন। সরকার এ উন্নয়নকে ‘পুরো বিশ্বের ও সব ধর্মের জন্য মিসরের উপহার’ হিসেবে প্রচার করছে। গত বছর মিসরের গৃহায়ণমন্ত্রী শেরিফ এল-শেরবিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি দর্শনার্থীদের সব পর্যটন ও বিনোদনমূলক সেবা দেবে; সেন্ট ক্যাথরিন শহর ও আশপাশের এলাকার উন্নয়ন করবে, পরিবেশগত, নান্দনিক ও ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করবে এবং প্রকল্পে কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে।’ অর্থসংকটের কারণে এই প্রকল্পের কাজ আপাতত থেমে থাকলেও সেন্ট ক্যাথরিন মঠের সামনে এল-রাহা সমভূমি ইতিমধ্যেই বদলে গেছে। সেখানে নতুন সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। তবে সমালোচকেরা বলছেন, এ অঞ্চলের বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।