ইন্ডিয়া টুডে: জন্মের পর থেকেই সাপে-নেইলে সম্পর্ক ভারত পাকিস্তানের। প্রতিবেশী হয়েও যেন বহু দূরত্ব তাদের। স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে গেলেও দু’দেশের সেই চিরবৈরী মনোভাব কাটেনি বিন্দুমাত্র। দোষারোপের রাজনীতি আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে যেন বের হতেই পারছেন না দেশ দুটির রাজনীতিকরাও। সাতচল্লিশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর অদ্যাবধি চারবার যুদ্ধে নেমেছে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটি ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ আর ১৯৯৯। বিগত ২৫ বছরে যুদ্ধে জড়ায়নি, তবে তাদের মধ্যে যে খুব শান্তি বিরাজমান ছিল তাও বলা যায় না। লাইন অব কন্ট্রোল সবসময় তাদের কন্ট্রোলে থাকে না, উত্তেজনা লেগেই থাকে। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ঘোলাটে এবং বেশ উত্তপ্ত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেন আধা জল খেয়ে লেগেছেন মোদি। শেষমেশ পরিস্থিতি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় কি-না এ নিয়ে শঙ্কিত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। গত মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। ২৫ ভারতীয় ও ১ নেপালিকে গুলী করে মেরেছে। ভয়াবহ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। হামলার কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, কাশ্মীরে ‘জনসংখ্যাগত পরিবর্তন’ রোধ করাই তাদের উদ্দেশ্য। তারা মনে করে, ভারত সরকার ২০১৯ সালে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (অনুচ্ছেদ ৩৭০) বাতিলের পর অন্য রাজ্যের মানুষ সেখানে বসবাস ও জমি কেনা শুরু করেছেন। এর ফলে সেখানে স্থানীয় মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। টিআরএফ গঠিত হয়েছে ২০১৯ সালে। ভারত সরকারের মতে, এটি পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা সংগঠন। লস্কর-ই-তৈয়বা ভারত ও পাকিস্তানে নিষিদ্ধ সংগঠন। আর টিআরএফ পাকিস্তানে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত।
কেষ্ট বেটাই চোর! : টিআরএফ দায় স্বীকারের পরও ভারত সরকার কাশ্মীরের ওই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটির বিরুদ্ধে বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। যেন ‘যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, কেষ্ট বেটাই চোর।’ ভারতকে ‘পাকিস্তান হামলায় জড়িত’ এ বিষয়ে প্রমাণ উপস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার। তবে এ ব্যাপারে এখনো কিছু জানায়নি দেশটি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছেÍ বহু পুরনো সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা, পাকিস্তানী নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা বাতিল, নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে নিযুক্ত সব সামরিক কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা। পাকিস্তানও থেমে নেই। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারতীয় নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা বাতিল, বাণিজ্য স্থগিত, ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা এবং ভারতের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে তারা।
সিন্ধুর পানি বন্ধ ‘যুদ্ধের উসকানি’ : সিন্ধুর পানি বন্ধ হলে এবার একটা লড়াই হয়েই যাবে এমনই হুঁশিয়ারি দিয়েছে পাকিস্তান। দেশটি বলেছে, ওই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যে পানি পাবে, তার প্রবাহ থামানো বা অন্যদিকে নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা ‘যুদ্ধের উসকানি’ বলে গণ্য হবে। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সই করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। এর আওতায় সিন্ধু, চন্দ্রভাগা, শতদ্রু, ঝিলাম, ইরাবতী ও বিপাশা নদীর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে একটি জরুরি বৈঠকের পর একটি বিবৃতিতে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা কঠোরভাবে নাকচ করে জানিয়ে দেওয়া হয়, এই পানি পাকিস্তানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু, যা দেশটির ২৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে। তাই সিন্ধুর পানি চুক্তি স্থগিত করলে বিষয়টিকে ভালোভাবে নেবে না পাকিস্তান। ভারতের প্রতি এটি পাকিস্তানের যেনতেন হুমকি নয়, যুদ্ধের মহাবিপদ সংকেত।
মোদির ইংরেজি বক্তব্য! : নরেন্দ্র মোদি ইংরেজি জানেন না সবাই তাই মনে করতেন এতদিন। তবে এবার চমক দেখালেন তিনি। বৃহস্পতিবার বিহারে এক বক্তব্যে ইংরেজি ভাষায় কাশ্মীরে হামলাকারীদের কঠোর বার্তা দিয়ে মোদি বলেন, বিহারের মাটি থেকে আমি পুরো বিশ্বকে বলছি, ভারত অবশ্যই হামলাকারীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনবে। পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তাড়া করে আমরা তাদের পাকড়াও করবো।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভারতের স্পিরিট (মনোভাব) বদলানো যাবে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের চেষ্টা করা হবে। সমগ্র জাতি আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, ওই সন্ত্রাসীদের এবং তাদের সহযোগীদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে যা তারা ভাবতেও পারবে না। তিনি হিন্দি ভাষায়ও বক্তব্য দিতে পারতেন। তবে তার ইংরেজি বক্তব্য রহস্যের জন্ম দিয়েছে। হয়তো পাকিস্তানসহ গোটা বিশ্বকে বোঝাতে তিনি এ ভাষা ব্যবহার করেছেন।
যুদ্ধের দামামা বাজছে : যুদ্ধপ্রিয় ভারতের কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো নয়। মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ (নেইবর ফার্স্ট) নীতি বলতে আসলে ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা’ নাকি ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালোবাসা’ প্রতিফলিত হয় তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। আরও একবার পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বাজছে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করেন, এ পর্যায়ে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে ভারত। তবে তার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানের এক নিরাপত্তা সূত্র আল-জাজিরাকে বলেন, আমরা বেশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। তবে ভারতের মতো অযথা উত্তেজনা তৈরি করছি না। এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার না থাকায় তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক ক্ষমতাধর। দু’দেশকেই সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারত যদি মনে করে, ইট মারলে পাটকেল খাবে না, তা ভুল।